• সেনাকে কুর্নিশ জানাতে গিয়ে ‘যুদ্ধে’ দুই ফুল
    এই সময় | ১১ জুন ২০২৫
  • এই সময়: ভারতীয় সেনাবাহিনীকে কুর্নিশ জানাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় নিজেদের মধ্যেই রীতিমতো ‘যুদ্ধ’ বাধিয়ে ফেলল শাসক–বিরোধী! দু’পক্ষের চিৎকার, চেঁচামেচি আর পরস্পরকে তোপ দাগার প্রতিযোগিতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে কুর্নিশ জানানোর বিষয়টি কিছুটা অন্তরালে চলে গেল বলেই রাজনৈতিক মহলের একাংশের অভিমত।

    পহে‍লগামে জঙ্গি হামলার পরে পাকিস্তানকে যোগ্য জবাব দেওয়ার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে মঙ্গলবার বিধানসভায় কুর্নিশ জানিয়েছে তৃণমূল–বিজেপি দু’পক্ষই। কিন্তু কুর্নিশ–পর্বের গোড়া থেকেই এ দিন বিধানসভায় প্রাধান্য পেয়েছে রাজনৈতিক আক্রমণ ও প্রতি–আক্রমণ। বিধানসভা অধিবেশন কক্ষে এ দিন সব থেকে বেশি উচ্চারিত হয়েছে, ‘ছিঃ’, ‘লজ্জা’, ‘ধিক্কার’–এর মতো শব্দগুলি। এর কোনওটাই অবশ্য পাকিস্তানি জঙ্গিদের উদ্দেশে নয়, সবই পরস্পরকে লক্ষ্য করে। কখনও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আক্রমণের তোড়ে বিরোধী দলনেতাকে ‘মিথ্যাবাদী’ আখ্যা দিয়েছে‍ন, কখনও বিরোধীরা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ‘ছিঃ মমতা, ছিঃ মমতা’ বলে স্লোগান তুলেছেন।

    এ দিন বিধানসভা অধিবেশনের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে কুর্নিশ জানিয়ে প্রস্তাব আনেন‍ স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে এই প্রস্তাবের উপরে আলোচ‍না যে বিশেষ শা‍ন্তিপূর্ণ হবে না, তার ইঙ্গিত মিলেছিল প্রথমার্ধের শেষ দিকেই। প্রথমার্ধে ওবিসি সমীক্ষা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বলার শেষ হতেই শুভেন্দু হাত তুলে কিছু বলতে চান। কিন্তু স্পিকার তাঁকে বলতে না–দিয়ে সভার বিরতি ঘোষণা করে দেন। ফলে দ্বিতীয়ার্ধে বিজেপি বিধায়করা যে সুর সপ্তমে তুলবেন, সেটা স্পষ্টই ছিল। তবে পরিস্থিতি সব থেকে বেশি উত্তপ্ত হয় সেনাবাহিনীকে কুর্নিশ সংক্রান্ত প্রস্তাবের উপরে মমতা বলার সময়ে।

    এ দিন মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ভাষণে পুলওয়ামা প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেই বাধা দেন বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা প‍ল। তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে বলেন, ‘আপ‍নি তো পুলওয়ামা নিয়ে রাজনীতি করেছিলেন।’ ভাষণ থামিয়ে মমতার জবাব, ‘বেশ করেছিলাম। আপনি রাজনীতি বোঝেন না। আপনি ফ্যাশন বোঝেন, রাজ‍নীতি বোঝেন না। আপনি ফ্যাশন নিয়ে বললে আমি শুনব। রাজনীতি নিয়ে জ্ঞান দেবেন না। আপনার কীর্তিকলাপ সব জানা আছে।’

    এতেই যেন আগুনে ঘি পড়ে। রে–রে করে ওঠেন বিজেপির বিধায়করা। পাল্টা চিৎকার করতে থাকেন তৃণমূল বিধায়করাও। তার মধ্যেই জঙ্গি দমনে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একের পর এক শেল ছুড়তে শুরু করেন মমতা। পাল্টা শুভেন্দুরাও ‘ছিঃ মমতা, ছিঃ মমতা’ বলে কোরাস ধরেন। হঠাৎ মমতা কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে আক্রমণের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেন শুভেন্দুর দিকে।

    স্লোগান দিতে থাকা বিরোধী দলনেতার দিকে তাকিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আপনি ভীষণ মিথ্যে কথা বলেন। কিছু জানেন না। উল্টোপাল্টা বকেন। বড্ড মিথ্যে কথা বলেন। আপনার মতো বিরোধী নেতা আমি জীবনে দেখিনি।’ তাঁর সংযোজন, ‘আপনি বিরোধী নেতা! দেশের লজ্জা।’ জবাবে হই হট্টগোলের মধ্যে শুভেন্দু চিৎকার করে ঠিক কী কী বলেন, তা পরিষ্কার শোনা যায়নি।

    তবে এ দিন বিধানসভার বাইরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে শুভেন্দুর পাল্টা বক্তব্য, ‘উনি আমাকে হাম্পিং ডাম্পিং লায়ার বলেছেন। এর কী মানে? নতুন ইংরেজি শুনলাম।’ তাঁর কটাক্ষ, ‘ওঁর আচার–আচরণ, মুখের ভাষা নর্দমার মতো।’ শুধু তাই নয়, বিধানসভার বাইরে মমতাকে আক্রমণ করে শুভেন্দু বলেন, ‘ভারতীয় নাগরিক হয়েও উনি পাকিস্তানকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন।’ যার প্রেক্ষিতে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে এ দিন বিধানসভায় স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিস আনে তৃণমূ‍ল।

    এ দিন বিধানসভায় শাসক–বিরোধী যুদ্ধে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, তৃণমূলের যে বিধায়করা সেনাবাহিনীকে কুর্নিশ জানানোর প্রস্তাবের উপরে বলতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশা‍না করেছেন, তাঁদের সংযত হওয়ার বার্তা দেওয়া হয় তৃণমূলের পরিষদীয় দল থেকেই। যেমন— ইটাহারের তৃণমূল বিধায়ক মোশারফ হোসেন যখন কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশানা করেন, তখন চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে তঁাকে থামতে বলেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস।

    আবার শুভেন্দু যখন প্রশ্ন তোলেন স্পিকারের আনা প্রস্তাবে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নেই কেন, তখন তাঁকে আক্রমণ করেন তৃণমূলের শিউলি সাহা। তাঁকে থামাতে দেখা যায় স্বয়ং মমতাকেই। কিন্তু সেই সৌজন্য রাজনীতি কার্যত শিকেয় উঠে যায় মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ পর্বে। বিধানসভার বাইরে সাংবাদিকদের অগ্নিমিত্রা বলে‍ন, ‘উনি আমার যুক্তি খণ্ডন করতে পারেননি। তাই ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন। উনি তো পুলওয়ামার পরে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমি সে কথা বলতেই উনি রেগে গেলেন। আমরাও বিধানসভায় ওঁকে ধিক্কার জানিয়েছি।’

  • Link to this news (এই সময়)