প্রধানমন্ত্রীর নৈশভোজে সদুত্তর মেলেনি অনেক প্রশ্নের! ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতৃত্ব, বিজেপি বলছে অসত্য দাবি বাংলার শাসকের
আনন্দবাজার | ১১ জুন ২০২৫
ভারত-পাক সংঘাত এবং ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিদেশের ‘প্রতিক্রিয়া’ পর্যালোচনা করার জন্য মঙ্গলবার রাতে সাতটি বহুদলীয় প্রতিনিধিদলের সদস্যদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু সেই নৈশভোজ পর্বকে ‘সময় নষ্ট’ বলে বর্ণনা করেছে তৃণমূল। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের তরফে ওই নৈশভোজে যোগ দিয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। নৈশভোজের পরে তিনি ঘনিষ্ঠমহলে ‘বিরক্তি’ প্রকাশ করেছেন।
যদিও বিজেপি সূত্রের দাবি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ‘উষ্ণ’ আদানপ্রদান হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের আবহ বোঝাতে রাতেই ভিডিয়ো প্রকাশ করে বিজেপি। সেখানেই বিভিন্ন নেতা-নেত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে দেখা যাচ্ছে। তবে ওই ভিডিয়োয় কোথাও অভিষেককে দেখা যায়নি। তৃণমূলের শীর্ষ সূত্রের বক্তব্য, অভিষেকের টেবিল পর্যন্ত আসেননি প্রধানমন্ত্রী।
সন্ত্রাসবাদের নেপথ্যে পাকিস্তানের ভূমিকা এবং ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর কথা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে ভারত থেকে সাতটি বহুদলীয় প্রতিনিধিদল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছিল মোদী সরকার। সেই প্রতিনিধিরা দেশে ফিরে এসেছেন। তাঁরা কী বললেন আর কী শুনে এলেন, তার নির্যাস জানতেই ওই নৈশভোজ বলে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন সূত্রের দাবি ছিল। কিন্তু সেই নৈশভোজে যা হয়েছে, তাতে তৃণমূল ‘সন্তুষ্ট’ নয়। দলের একটি সূত্রের বক্তব্য, নৈশভোজে ভোজ এবং মূলত হাসি-মশকরা ছাড়া ‘গঠনমূলক’ কিছু হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সূত্রের পাল্টা বক্তব্য, এই ধরনের নৈশভোজ সমসময় মূলত ‘সামাজিক অনুষ্ঠান’ হয়। সেখানে বিশদ আলোচনার কিছু থাকে না। কোনও নির্ধারিত আলোচ্যসূচিও থাকে না। তেমন সামাজিক ভাবেই প্রধানমন্ত্রী ওই প্রতিনিধিদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এগুলি সংসদীয় রাজনীতির ‘শিষ্টাচার’।
লোককল্যাণ মার্গে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের চত্বরে সাতটি টেবিলের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। সেখানেই বসেছিলেন প্রতিনিধিদলের সদস্যেরা। তৃণমূলের বক্তব্য, অভিষেক যে টেবিলে বসেছিলেন, সেই টেবিল পর্যন্ত যাননি প্রধানমন্ত্রী। যদিও দিল্লিতে এই ধরনের নৈশভোজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অনেকের বক্তব্য, আমন্ত্রিতদের সংখ্যা অনেক হলে প্রত্যাশিত ভাবেই প্রধানমন্ত্রী সকলের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। অতীতে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে নরসিংহ রাও বা ইন্দ্রকুমার গুজরাল যখন প্রধানমন্ত্রীর নৈশভোজে অতিথিদের আমন্ত্রণ জানাতেন, তখনও তাঁরা সকলের সঙ্গে গিয়ে কথা বলতেন না। তার প্রেক্ষিতে আবার তৃণমূলের বক্তব্য যে, অন্যান্য প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এই প্রতিনিধিদলের তফাত রয়েছে। এই নৈশভোজকে ‘অনুষ্ঠান’ হিসেবে না দেখে ‘কর্মসূচি’ হিসাবে দেখা উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রীর।
ওই নৈশভোজে ছিলেন বিজেপি-র রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য। তাঁর বক্তব্য, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কর্মসূচি সম্পর্কে তৃণমূল যা বলছে, তার চেয়ে কদর্য অসত্য আর কিছু হয় না। যেখানে জাতীয় স্বার্থ জড়িত, যে প্রশ্নে অন্য সব রাজনৈতিক দল ভেদাভেদ ভুলে এক হতে পেরেছে, সেখানে একমাত্র তৃণমূল এই ধরনের কথা বলছে। এর পরে তৃণমূলকে আর রাজনৈতিক দল হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত নয়!’’ প্রধানমন্ত্রী অভিষেকদের টেবিল পর্যন্ত যাননি বলেও তৃণমূল সূত্রে দাবি করা হয়েছিল। শমীক পাল্টা দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রী নৈশভোজে ঢোকার সময় অভিষেক একেবারে সামনেই ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে সৌজন্যমূলক করমর্দন করেন। তাঁদের সংক্ষিপ্ত কুশল বিনিময়ও হয়। কিন্তু তার পরে অভিষেক আর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে যাননি। শমীকের কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী যেমন বিরোধীদের প্রতি উষ্ণতা দেখিয়েছেন, তেমনই বিরোধী নেতারাও বিভিন্ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে গিয়েছেন। তৃণমূলের প্রতিনিধির মধ্যে সেই উষ্ণতার অভাব ছিল।’’
মোদী কেন অভিষেকের টেবিল পর্যন্ত যাননি, তার একটি ব্যাখ্যা মিলেছে অভিষেকের ঘনিষ্ঠমহল সূত্রে। সেই ব্যাখ্যা বলছে, ওই সাতটি প্রতিনিধিদলের সদস্যদের প্রত্যেককেই প্রধানমন্ত্রীর দফতর মনোনীত করেছিল। ব্যতিক্রম অভিষেক। প্রথমে তৃণমূল নেতৃত্বকে না-জানিয়ে বহরমপুরের সাংসদ ইউসুফ পাঠানকে তৃণমূলের প্রতিনিধি হিসাবে রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মমতা এবং অভিষেক। তাঁরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, কেন্দ্র বা পক্ষান্তরে শাসকদল বিজেপি ঠিক করতে পারে না তৃণমূলের তরফে কে যাবেন। তা দলই ঠিক করবে। এর পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু মমতাকে ফোন করলে অভিষেকের নাম প্রস্তাব করেছিলেন তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী। অভিষেক যে প্রতিনিধিদলে ছিলেন, সেটি গিয়েছিল এশিয়ার পাঁচটি দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, কুয়ালা লামপুর, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ায়। সফর শেষে আবার রিজিজুর দফতর থেকে ফোন করে অভিষেককে প্রধানমন্ত্রীর নৈশভোজে থাকার অনুরোধ জানানো হয়। অভিষেক নৈশভোজে যান। কিন্তু সেখানে ‘কাজের কাজ’ কিছু হয়নি বলে তৃণমূল নেতৃত্ব ‘ক্ষুন্ন’। সে কারণেই অভিষেক সেখানে এক কাপ চা ছাড়া আর কিছু খাননি বলেও তৃণমূল সূত্রে জানানো হয়েছে।
যদিও শমীকের বক্তব্য পুরো এর বিপরীত। ওই নৈশভোজকে ‘অভূতপূর্ব’ আখ্যা দিয়ে শমীক বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নিজেও খুব ভাল মেজাজে ছিলেন। বিদেশ-প্রত্যাগত প্রতিনিধিরাও খুশি ছিলেন। দলমতনির্বিশেষে রাজনৈতিক ঐক্যের এমন আবহ আমি এর আগে খুব একটা দেখিনি।’’ উল্টে বিজেপি সাংসদের বক্তব্য, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বরং বিজেপি সাংসদদের সঙ্গে কম কথা বলেছেন। বিরোধী শিবিরর প্রতিনিধিদের সঙ্গেই তিনি বেশি সময় কাটিয়েছেন।’’ তাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মিনিটদুয়েক কথা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজেপি সাংসদ। কথা হয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে।
তৃণমূলের তরফে দাবি, পহেলগাঁওয়ের চার জন জঙ্গি কোথায়, তাদের ধরতে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, সংসদের বিশেষ অধিবেশন হবে কি না, এই সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলি নিয়ে কোনও কথা হয়নি। যদিও পাল্টা এই বক্তব্যও আসছে যে, প্রধানমন্ত্রী আহূত নৈশভোজে এই সমস্ত বিষয়ে কথা হবে এমন কিছু আগে থেকে বলা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর দফতরও প্রতিনিধিদের এমন কিছু জানায়নি। সেই প্রেক্ষিতেই কেন্দ্রের একাধিক সূত্রের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর নৈশভোজ ‘সৌজন্যমূলক এবং সামাজিক’। কখনও এই ধরনের অনুষ্ঠান পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার মঞ্চ হয়ে ওঠে না।
বিজেপি যে ভিডিয়োটি প্রকাশ করেছে, তাতে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে ভিড়ের মধ্যে কংগ্রেসের সাংসদ শশী তারুরের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কথোপকথনের ছবি সর্বাগ্রে দেখানো হয়েছে। এর পরে দেখা যাচ্ছে গুলাম নবি আজাদের পিঠ চাপড়ে একগাল হেসে এগিয়ে যাচ্ছেন মোদী। প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদী, যিনি বিজেপি-র সমালোচক, তাঁর সঙ্গে আলাদা করে মোদী কথা বলেছেন বলে ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে। সেখানে প্রিয়ঙ্কার পাশে আছেন সুপ্রিয়া সুলে এবং কানিমোঝি। কানিমোঝি মোদীকে একটি দক্ষিণী বস্ত্র উপহার তুলে দিচ্ছেন। সেটি নিয়ে মোদী সুপ্রিয়ার সঙ্গে কথা বলছেন। কংগ্রেসের আনন্দ শর্মা, সলমন খুরশিদ, মণীশ তিওয়ারিদের সঙ্গেও মোদীর কথোপকথনের ছবি দেখা গিয়েছে ভিডিয়োটিতে। তবে বিজেপি নেতারা যে ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন, সেখানে অভিষেক অনুপস্থিত।