• বাড়তে থাকা সিমন্টের জঙ্গলে গাছ বাঁচিয়েই ঘর গড়লেন চাষি
    এই সময় | ১২ জুন ২০২৫
  • দিগন্ত মান্না, পাঁশকুড়া

    ‘পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা...।’ সাধের বাগানের শ্রী বাড়াতে উপেনকে কথাগুলো বলেছিলেন রাজা। রবি ঠাকুরের 'দুই বিঘা জমি'র সেই উপেনের শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল, তা আমরা সবাই জানি।

    কিন্তু, বাড়ি তৈরিতে বাধ সাধছে একটি নারকেল গাছ! ক’জন গৃহস্থ সে বাধা মানবেন? বেশিরভাগ লোকজন গাছটিকে ঘ্যাচাং ফু করে দেবে। তারপরে তরতরিয়ে উঠবে বাড়ি।

    কিন্তু এই চেনা পথে হাঁটেননি ডেবরার দামোদরপুরের বামাপদ পাল। গাছ কাটার প্রসঙ্গ উঠতেই হাত তুলে তিনি সবাইকে থামিয়ে দেন। নরম গলায় বলেন, ‘আহা তা কেন, এতদিনের গাছ, ও যেমন আছে তেমনই থাক!’

    তা হলে বাড়ি উঠবে কী করে? বামাপদ তাঁর ভাই গৌরকে বলেন, ‘কী রে, তুই তো রাজমিস্ত্রি। গাছটাকে অক্ষত রেখে বাড়ি তৈরি করতে পারবি না?’ গৌর বেশ কিছুক্ষণ সাদা কাগজে আঁক কষে, গাছের গোড়ায় গিয়ে মাপজোক করে জানান, তিনি পারবেন।

    গৌর পেরেছেন। দাদার কথাও রেখেছেন। বছর দুয়েক আগে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দোতলা পাকা বাড়ি। হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে সেই নারকেল গাছটিও। যা দেখে গ্রামের লোকজনও বলাবলি করেন, ‘গাছের উপরে ঘর তৈরির কথা শুনেছি। ছবিতেও দেখেছি। কিন্তু আমাদের বামাপদ তো গাছের জন্যই আস্ত ঘর গড়ে ফেলল গো!’ কথাটা একেবারে ফেলনা নয়।

    নারকেল গাছটিকে মাঝখানে রেখেই তৈরি করা হয়েছে ছাদ। ঝড়ে গাছটি দুললেও যাতে বাড়িতে আঘাত না-লাগে তার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রাখা হয়েছে। গাছের গোড়া যে জায়গায়, সেখানে একটি ঘর তৈরি করছেন বামাপদ।

    তার একদিকে রান্না হয়। বাকি অংশ খোলাই থাকে। গাছের গোড়ায় জল দেওয়ার জন্য পাকা ব্যবস্থাও করা হয়েছে। দোতলার যে অংশটি দিয়ে গাছটি উঠে গিয়েছে সেখানে তৈরি করা হয়েছে বারান্দা।

    সেই বারান্দায় থেকেও দিব্যি ধরা যায়, ‘বৃক্ষতলে শুয়ে...।’ বাড়ি তৈরির আগে দৈর্ঘ্য, প্রস্থের চুলচেরা হিসেব নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সকলেই। নকশা অনুযায়ী বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট তৈরির জন্য গাছ কেটে ফেলারও নজির রয়েছে ভূরি ভূরি।

    পেশায় চাষি বামাপদের প্রথাগত শিক্ষা তেমন নেই। কোনও দিন মঞ্চে উঠে বৃক্ষপ্রেম নিয়ে বক্তৃতা দেননি। তিনি বৃক্ষপ্রেমী সংগঠনের সদস্যও নন। তবে তাঁর নিটোল বৃক্ষপ্রেম দেখে সকলেই অবাক।

    স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, বৌমা ও নাতনি নিয়ে জমজমাট পরিবার বামাপদের। গাছের সঙ্গে সংসার হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন তাঁরাও। গাছের গা বেয়ে বৃষ্টির জল যাতে ঘরে ঢুকে না-পড়ে সে জন্য পলিথিনের ব্যবস্থাও করেছেন বামাপদ।

    তারপরেও একটু-আধটু জল ঢুকলে পাল পরিবারের সদস্যরা হাসিমুখেই পরিষ্কার করে দেন। বাড়ির সামনের আমগাছের ডাল জানলা দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়েছে। সেই ডাল কাটতেও আপত্তি বছর ঊনষাটের বামাপদের। কিছু বলতে গেলেই তাঁর সেই এক গোঁ, 'থাক না, ওগুলো তো কারও কোনও ক্ষতি করছে না।’

    বামাপদ বলছেন, ‘সারাটা জীবন চাষ-আবাদ করেই কাটল। চোখের সামনে তিলতিল করে গাছের বড় হওয়া দেখেছি। অকারণে সেই গাছ কাটব কেন?’ তনুশ্রী পাল বলেন, ‘গাছের প্রতি বাবার খুব টান। বাড়ি তৈরির সময়ে নারকেল গাছটিকে কিছুতেই কাটতে দেয়নি বাবা। তারপরে কাকা অনেক পরিকল্পনা করে গাছটিকে রেখেই বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে।’

    সম্প্রতি বামাপদের বাড়ি ঘুরে এসেছেন বৃক্ষপ্রেমী, পেশায় শিক্ষক দেবাশিস পট্টনায়ক। তিনি বলেন, ‘এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। গাছ ও মানুষের সহাবস্থান দেখে মুগ্ধ হয়েছি। ওই কৃষককে কুর্নিশ জানাই।’

  • Link to this news (এই সময়)