‘সঠিক পদ্ধতি মেনে রায় দেননি বিচারপতি অভিজিৎ’, চাকরি বাতিল মামলায় অভিযোগ রাজ্যের
আনন্দবাজার | ১২ জুন ২০২৫
প্রাথমিকে ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল মামলায় কলকাতা হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলল রাজ্য। তাঁর বিচার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) কিশোর দত্ত। বৃহস্পতিবার প্রাথমিক মামলার শুনানিতে বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রতকুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চে তাঁর বক্তব্য, ‘‘তখনকার সিঙ্গল বেঞ্চের বিচারপতির সঠিক বিচার পদ্ধতি মেনে বিচার করেননি। শুনানি পদ্ধতি নিয়ে একাধিক প্রশ্ন রয়েছে। সিঙ্গল বেঞ্চ সকলকে বলার সুযোগ দেয়নি। বিচারপতি খেয়ালখুশি মতো শুনানি পর্ব চালিয়ে গিয়েছেন।’’
বৃহস্পতিবার দুপুর ২টো থেকে এই মামলার শুনানি শুরু হয়। বিকেল সাড়ে ৪টে পর্যন্ত চলে শুনানি। রাজ্য তথা পর্ষদের তরফে সওয়াল করেন এজি। আগামী ২৩ জুন এই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে। এই মামলায় বৃহস্পতিবার এজি অভিযোগ করেন, মামলাকারীদের বক্তব্য শোনার পরে শুনানি স্থগিত করে দিয়েছিলেন তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ। তার পরে পর্ষদের কাছে পাল্টা হলফনামা তলব করেছিলেন। অথচ আগে সেই একই আবেদন তিনি বাতিল করে দিয়েছিলেন। এজির উদ্দেশে ডিভিশন বেঞ্চের মন্তব্য, ‘‘এখন কেন এই দাবি করছেন? আপনারা তখন তা মেনে নিয়েছিলেন। নির্দেশনামায় সে সবের উল্লেখ রয়েছে।’’ তখন এজি সাফাইয়ে বলেন, ‘‘কিছু করার ছিল না। প্রতিটি নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে তো আর ডিভিশন বেঞ্চে যাওয়া যায় না।’’ তাঁর সওয়াল, ‘‘বিচার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যে কাউকে যখন খুশি ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন ওই বিচারপতি। বিরুদ্ধে কোনও নির্দেশ দিতেই পারেন। কিন্তু একটি পদ্ধতি তো অবলম্বন করা উচিত।’’
প্রাথমিকে চাকরি বাতিলে তৎকালীন বিচারপতি অভিজিতের রায় ঘোষণার পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তোলের এজি। তিনি বলেন, ‘‘শুনানি শেষের পরের দিনই রায় ঘোষণা করে দিলেন। এত তাড়া কীসের ছিল? বিচারপতি (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় শুনানি শেষের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রায় দিতেন। সেটা তিনি পরম্পরা করে নিয়েছিলেন। বলতেন, যত বড় মামলা হোক শুনানি শেষের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রায় ঘোষণা করব। প্রাথমিক মামলার রায় এর তড়িঘড়ি দেওয়া হল কেন?’’ প্রাথমিকের নিয়োগে শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে বলে আগেই দাবি করেছিল প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। এজির যুক্তি, দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য কোনও তথ্য প্রমাণ সামনে আসেনি। দুর্নীতির অভিযোগের পরিণাম মারাত্মক। কিন্তু শুধু অনুমানের ভিত্তিতে বিচারপতি দুর্নীতির কথা লিখে দিলেন।
রাজ্যের আইনজীবীর অভিযোগ, পুরো মামলার শুনানিতে নিম্ন আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার কাজ করেছে সিঙ্গল বেঞ্চ। আইনকে পাশে সরিয়ে পুরো রায় দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকের ৩২ হাজার চাকরি বাতিলের পিছনে ‘অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট’ না নেওয়ার কারণ দেখিয়েছে সিঙ্গল বেঞ্চ। পর্ষদ জানায়, এই অভিযোগের কোনও গুরুত্ব নেই। জেলাভিত্তিক মেধাতালিকা প্রকাশ হয়। ওই টেস্টও সেই অনুযায়ী নেওয়া হয়েছিল। পাল্টা বিচারপতি চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘এখন বলছেন মেধাতালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু এর আগে আপনারাই জানিয়েছেন প্রকাশ করা হয়নি। আপনাদের কোন অবস্থান সঠিক?’’ এ ছাড়া এই মামলার শুনানিতে পর্ষদের উদ্দেশে ডিভিশন বেঞ্চ প্রশ্ন তোলে, উত্তরপত্র বা ওএমআর শিট মূল্যায়নে বাইরের সংস্থাকে কেন বেছে নেওয়া হয়েছিল? কী ভাবে মূল্যায়নের বরাত পেল ওই সংস্থা? কেন প্রথমে বরাতের বিষয়ে অন্য কেউ জানল না? কোন আইনের ভিত্তিতে তাদের বরাত দেওয়া হল?
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ১৬ মে কলকাতা হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ এই চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা করে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ এবং চাকরিহারা শিক্ষকেরা। এর পরে সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ের উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিয়েছিল বিচারপতি সুব্রত তালুকদার এবং বিচারপতি সুপ্রতিম ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ। তার পর সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা হয়েছিল। যদিও শীর্ষ আদালত হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চেই এই মামলা ফেরত পাঠায়। গত ৭ এপ্রিল সাময়িক ভাবে শুনানি স্থগিত হয়ে গিয়েছিল বিচারপতি সৌমেন সেন এই মামলা থেকে সরে দাঁড়ানোয়। ২০১৪ সালের টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার প্রার্থী। পর্ষদ ২০১৬ সাল থেকে তাঁদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করে। চাকরি দেওয়া হয় ৪২ হাজার ৯৪৯ জনকে। কিন্তু ওই নিয়োগে একাধিক ত্রুটির অভিযোগ করে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা দায়ের হয়েছিল। তারই ভিত্তিতে চাকরি বাতিলের রায় দিয়েছিল সিঙ্গল বেঞ্চ।