দগ্ধ বৈশাখে আদিদেব শালগ্রাম শিলাকে জলের ঝোরার মধ্যে বসিয়ে শীতলতার দিকে যে প্রতীকী যাত্রার শুরু, জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রায় তা সম্পূর্ণ হয়। সূচনা হয় বাঙালির উৎসব মরসুমের।
ফাল্গুনে দোল মিটলেই বঙ্গের উৎসব পর্যায়ে একটা লম্বা ছেদ পড়ে। তার পরে তপ্ত গ্রীষ্ম। জলহীন নদীনালা শুকিয়ে কাঠ। শস্যক্ষেত্র ফেটে চৌচির। ফসলহীন মাঠের কৃষক বৃষ্টির দেবতার কাছে জলের প্রার্থনায় আকুল। সে বড় সুখের সময় নয়। উৎসবের উপযুক্ত তো নয়ই। তার পরে কোনও এক দিন আকাশ কালো করে আসে। মৌসুমি বায়ু ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামালেই উৎসবের শুরু। তখন মাঠে মাঠে বীজবপনের পর্ব। নববর্ষার জলধারায় ভিজে কুমারী মাটি হয়ে ওঠে প্রসবিনী। পালিত হয় অম্বুবাচী। ‘অম্বু’ অর্থে জল, ‘বাচি’ অর্থে কথা বলা। অর্থাৎ জল কথা বলে। বলে নতুন ফসলের কথা। নতুন জীবনের কথা। সেই খুশিতে মাটির সঙ্গে ভেজে মানুষ। স্নিগ্ধ শীতল সুগন্ধি জলের ধারায় ভিজিয়ে দেয় তার ইষ্টদেবতা- জগৎ প্রতিপালক, জগতের নাথকে।
নবদ্বীপের গঙ্গার পূর্বপাড়ে মায়াপুরের ইস্কন মন্দির থেকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরের রাজাপুরে শতাব্দী প্রাচীন জগন্নাথ মন্দিরে ইস্কনের তত্ত্বাবধানে পালিত হল স্নানযাত্রা। বুধবার অনুষ্ঠিত হয় প্রথামাফিক স্নানযাত্রা। ১০৮ ঘড়া গঙ্গাজল সঙ্গে দুধ, দই, মধু, চন্দন, অগুরু, আতর ও গোলাপ জলের মতো রকমারি দ্রব্য দিয়ে স্নানাভিষেক করানো হয় জগন্নাথদেবকে। পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের উপস্থিতিতে উৎসব জমজমাট হয়ে ওঠে।
অন্য দিকে, গঙ্গার পূর্বপাড়ে নবদ্বীপে এ দিন পালিত হয় এক ব্যতিক্রমী উৎসব। বৃক্ষ দেবী নবদ্বীপেশ্বরী পোড়মার আবির্ভাব উৎসব। যদিও ধর্মীয় পরিমণ্ডলে তবু এমন সাড়ম্বর বৃক্ষবন্দনার আয়োজন বড় একটা দেখা যায় না। যদিও পাথুরে প্রমাণ নেই তবু অনেক কাল ধরে এই আখ্যান প্রচলিত।
বহুকাল আগের কোনও এক গ্রীষ্মকালের কথা। প্রবল খরার জ্বলছে সে বার গোটা দেশ। নদী পুকুর শুকিয়ে কাঠ। দগ্ধ গাছপালা। নবদ্বীপের প্রাণকেন্দ্র পোড়ামাতলার সুবিশাল বটবৃক্ষও আক্রান্ত। তাপে ক্রমেই শুকিয়ে আসছে বিশাল গাছ। পণ্ডিতেরা বিধান দিলেন গঙ্গা থেকে সহস্র কলস জল এনে অভিষিক্ত করতে হবে বৃক্ষ দেবতাকে। জ্যৈষ্ঠমাসের স্নানযাত্রার দিনে হল অভিষেক। নতুন ভাবে যেন প্রাণ ফিরে পেল পোড়ামাতলার বটগাছ।
সেই শুরু। তার পর থেকে প্রতি বছর স্নানযাত্রার দিনে নবদ্বীপে পোড়ামা পুনরাবির্ভাব উৎসব উদ্যাপন হয়ে আসছে। কোনও বছরে সেই মারত্মক খরা হয়েছিল কিম্বা কবে থেকেই এই উৎসবের সূচনা তা নিয়ে কোনও পাথুরে প্রমাণ মেলে না। তাতে অবশ্য উদ্যাপনের আয়োজনে কোনও খামতি নেই। এ দিন সকাল থেকেই পোড়ামাতলায় মানুষের ঢল। অন্য দিকে, নবদ্বীপের বিভিন্ন জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা পালিত হয়।