পাহাড়ে চড়তে এসে তেহরানে আটকে আছি! ঘুমোতে পারছি না বোমার শব্দে, ভয় করছে, কী করে ফিরতে পারব কলকাতায়?
আনন্দবাজার | ১৬ জুন ২০২৫
ভয় লাগছে। আতঙ্ক হচ্ছে। ফিরতে পারব তো আর কলকাতায়? ফিরলে কবে? সেই ক’দিন চলবে কী করে? টাকাপয়সা শেষ হয়ে যাবে কয়েক দিনেই। তার মধ্যে বোমার ভয়। লাগাতার বোমা পড়ার শব্দ হচ্ছে। হোটেলের ঘরে আমি আটকে। একা একটা ঘরে। রাস্তায় যতটা সম্ভব কম বেরোতে বলা হচ্ছে। বুঝতেই পারছি না কী হবে, কী করব!
গত শনিবার তেহরান থেকে ওমানের বিমান ধরে, সেখান থেকে মুম্বই হয়ে কলকাতায় ফেরার কথা ছিল আমার। শুক্রবারটা সব কিছু ওলটপালট করে দিল। পাহাড় চড়তে এসেছিলাম ইরানে। এমন অবস্থায় যে পড়ে যেতে পারি কল্পনাও করিনি।
শুক্রবার সন্ধেবেলা থেকে শুরু হল বোমার আওয়াজ। একটার পর একটা। প্রথমে তো বুঝতেই পারছিলাম না কী হল, কী হচ্ছে! শুধু ভয় লাগছিল। একদম একা একা, অচেনা জায়গায় এমন বিপদে পড়ে গেলাম, কী হবে কে জানে! হোটেলের বাকিদের অবস্থাও এক। বোমার আওয়াজ পেলেই অনেকে জানলা খুলে দেখার চেষ্টা করছে। যে হোটেলে আছি, সেখানে লোকজন খুব কম। আমার ঘরে একাই আছি। হোটেলে কোনও ভারতীয়কে দেখতে পাইনি। হোটেল থেকে বেরিয়েছিও খুব কম। রাস্তাতেও কোনও ভারতীয়ের দেখা পাইনি। এখানে আমার কোনও বন্ধুও নেই। দেড় কিলোমিটার দূরে এক ইন্দো-অস্ট্রেলীয় বন্ধু আছে বটে, কিন্তু সে-ও নিজের হোটেলে আটকে।
৬ জুন ইরানের রাজধানী তেহরানে এসে পৌঁছেছিলাম। লক্ষ্য ছিল মাউন্ট দামাবান্দ। তেহরান থেকে সড়কপথে দু’ঘণ্টা দূরত্বে এল বোর্জ় পর্বত। সেখানেই দামাবান্দ শৃঙ্গ। এশিয়ার উচ্চতম আগ্নেয়গিরি। সেখানেই সামিট করতে এসেছিলাম। আরও নানা দেশের লোকজন ছিল। ভারতীয় আমি একাই। পর্বতোরোহণ আমার নেশা। কিন্তু সেই নেশার টানে এসে যে এমন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হবে তা ভাবিনি। আমি আটকে রয়েছি মধ্য তেহরানের তালেঘানি এলাকায়। যে হোটেলটায় আটকে রয়েছি তার নাম মাসাদ।
তেহরানে এসে পরের দিনই পর্বতারোহণ শুরু করেছিলাম। কিন্তু সেখানেও ভাগ্য খারাপ। আবহাওয়া সঙ্গ দিল না। ৫,২০০ মিটার পর্যন্ত উঠে নীচে নেমে যেতে হল। মাত্র ৪০০ মিটারের জন্য সামিট শেষ করতে পারলাম না। মনটা খুব খারাপ ছিল। যার জন্য এলাম সেটা তো আর হল না। বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করছিলাম। ইচ্ছে ছিল, কিছু ক্ষণ তেহরান শহরটা একটু ঘুরেও দেখে নেব। যতটুকু সম্ভব। কিন্তু তেহরানে পা দেওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই বুঝলাম, বড়সড় কিছু একটা ঘটেছে। জানতে পারলাম, যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। ইজ়রায়েল আক্রমণ করেছে। টেলিভিশনেও দেখলাম ইজ়রায়েলি হামলার ছবি। তার পর থেকেই ইরানের আকাশপথ বন্ধ করে দেওয়া হল। বিমান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ। আটকে গেলাম হোটেলে।
শুরুতে থাকা-খাওয়ার সমস্যা ছিল না। কারণ, শনিবার পর্যন্ত আমার হোটেলের সব টাকা মেটানো ছিল। যে এজেন্সির সঙ্গে এসেছি, তারাও সাহায্য করেছে। পর্বতারোহণের পর এক-দু’দিনের মধ্যে আমার ফেরার কথা ছিল। সেইমতোই টাকা এনেছিলাম। কিন্তু এখন এখানে কত দিন আটকে থাকতে হবে জানি না। যা টাকা আছে আরও দু-তিন দিন চালিয়ে নেব। কিন্তু তার পর? এক সময় তো টাকা শেষ হয়ে যাবে। তখন কী করব? চিন্তা হচ্ছে। এখানে হোটেলে প্রতি দিন ঘরভাড়ার খরচ ৪০ ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা)। এর থেকে কম দামের ঘর এই হোটেলে নেই। তাই আশেপাশে খোঁজ নিচ্ছি কমদামি হোটেল পাওয়া যায় কি না। তা হলে সেখানে চলে যাবে। আরও কয়েকটা দিন তা হলে চলে যাবে।
তেহরানে পৌঁছোনোর পর ভারতের রাষ্ট্রদূত রুদ্র গৌরব শ্রেষ্ঠর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। ফেরার মুখে আটকে যাওয়ার পরেও দূতাবাসের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখছি। ওখানে আমার নাম, নম্বর, হোটেলের নাম সব দেওয়া আছে। ওরা বলছে— শান্ত থাকুন, ঘরের ভিতরে থাকুন, আতঙ্কের কিছু নেই। বলছে, এই সমস্যা তাড়াতাড়ি মিটে যাবে। কিন্তু শুক্রবার রাত থেকে যে ভাবে বোমার আওয়াজ পাচ্ছি তাতে ভরসা পাচ্ছি না। যে এজেন্সির সঙ্গে এসেছি ওরাও যোগাযোগ রাখছে না এমন নয়। আমার বাড়ির লোকেরাও চিন্তায় পড়ে গিয়েছে। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। কিন্তু যত দিন না সংঘর্ষবিরতি হবে তত দিন আকাশপথ খুলবে না। সকলে নিজেদের মধ্যে এই নিয়েই আলোচনা করছে। বাড়ি ফিরতে চাই। এই অবস্থাটা অসহ্য লাগছে।
শুরুতে ঠিকঠাক থাকলেও এখন থাকা-খাওয়া নিয়ে দূতাবাস ও এজেন্সির মধ্যে একটা দায় ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছে। দূতাবাস বলছে, যে এজেন্সি নিয়ে এসেছে তারা থাকা-খাওয়ার খরচ দেবে। এজেন্সি বলছে, দূতাবাস দেবে। দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা বলছে, বাড়ি থেকে টাকা পাঠাতে বলুন। কিন্তু এখানে সব ব্যাঙ্কও তো বন্ধ। টাকা আমি হাতে কী ভাবে পাব?
এর মধ্যেই হোটেলে পুলিশ এসেছিল। ওরা বলল, এখনও দু’মাস যুদ্ধ চলবে। মজা করে বলল না সত্যি বলল, বুঝতে পারলাম না। হোটেলের কর্মীরা নিজেদের ভাষায় খবর দেখছে। নিজেদের ভাষায় কথা বলছে। তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারছি না। এখানকার অবস্থা ঠিক কেমন তার কোনও আন্দাজও পাচ্ছি না। তবে একটা বিষয় বুঝতে পারছি। এখনই দেশে ফিরতে পারব না। তেমন কোনও আশা দেখতে পাচ্ছি না।
শুধু আমারই এই অবস্থা নয়। শুনেছি সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার ভারতীয় এখানে। সকলেই আটকে। দূতাবাসই বা কত জনকে সাহায্য করবে? সারা ক্ষণ ফোন বাজছে। ঠিকমতো কথা বলারও সময় নেই ওদের। দায়সারা উত্তর দিচ্ছে। তার মধ্যেই শুনলাম, রাশিয়া নাকি ওদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভারত সরকার তো এখনও তেমন কিছু করল না। এই অবস্থায় কত দিন থাকতে হবে জানি না। সারা রাত ঘুম আসছে না। একটা করে বোমার শব্দে চমকে চমকে উঠছি। জানি না এই দুঃস্বপ্ন কবে শেষ হবে।