নিম্ন আদালতে একটি মামলার রায়ের সার্টিফায়েড কপি আনতে গিয়েছিলেন মামলার সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তি। আদালতে গেলে তাঁকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। কম্পিউটার ঘেঁটে আদালতের ক্লার্ক দেখেন প্রায় ৫০ পাতার কপি।
তিনি ওই ব্যক্তিকে বলেন, ৫০টি এ-ফোর সাইজ়ের পেপার বাইরে থেকে কিনে আনতে। বেশ অবাক মামলাকারী। বুঝতে পেরে ক্লার্ক বলেন, ‘কাগজ কেনার টাকা নেই আদালতের। হাল এতটাই খারাপ যে পেন, পেন্সিল থেকে প্রিন্টারের কার্টিজ়ও জোগাড় করতে হচ্ছে আইনজীবীদের বা ক্লার্কদের অনুরোধ–উপরোধ করে।’
জেলার এক বিচারবিভাগীয় প্রশাসক বলছেন, ‘বাইরে থেকে স্টেশনারি কিনতে টেন্ডার করতে হয়। রাজ্যেরই বিভিন্ন কো–অপারেটিভ থেকে কিনতে তা লাগে না। তাই স্টেশনারি আসে মূলত কো–অপারেটিভ থেকে।
এই মুহূর্তে বিভিন্ন জেলায় কো–অপারেটিভের কাছে লক্ষ লক্ষ টাকা বকেয়া পড়ে রয়েছে। কবে টাকা পাবে তা কো–অপারেটিভগুলি জানে না। তাই বাইরে যে স্টেশনারির দাম ১০ টাকা, কোনও জেলায় তা ১৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
নগদ না থাকায় আমরাও বাধ্য হয়ে কিনছি।’ জানা গিয়েছে, শুধু পশ্চিম মেদিনীপুরে এখন স্টেশনারি বাবদ ৩৫ লক্ষ টাকা বকেয়া পড়ে রয়েছে।
হাইকোর্ট সূত্রে খবর, জেলার আদালতে গাড়ি, স্টেশনারি, পরিকাঠামো–সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পৃথক হেডে টাকা বরাদ্দ করে রাজ্য।দীর্ঘদিন জেলা জজের দায়িত্ব সামলে হাইকোর্ট থেকে অবসর নেওয়া এক বিচারপতির কথায়, ‘প্রতি বছর জেলা থেকে আনুমানিক খরচের একটা হিসাব রাজ্যকে পাঠানো হয়।
বাস্তবে সেই টাকা আদায় করতে জেলা জজদের নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে। কোনওভাবে গাড়ির তেলের টাকা যদিও বা কোনও জেলা জজ দৌড়ঝাঁপ করে আদায় করতে পারছেন, স্টেশনারি বাবদ ৫০ শতাংশ টাকা পাওয়া মানে ভাগ্যের ব্যাপার। দুই ২৪ পরগনা, দুই মেদিনীপুর, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার বা মালদা — সর্বত্র একই ছবি।’
সমস্ত নিম্ন আদালতেই লক্ষ লক্ষ টাকার বিদ্যুতের বিল বাকি পড়ে রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। উদাহরণ দিয়ে এক বিচারবিভাগীয় অফিসার জানিয়েছেন, শুধু পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাতেই ৫৫ লক্ষ টাকার বিল বকেয়া পড়ে। তার মধ্যে শুধু খড়্গপুরেই বকেয়া ৩০ লক্ষ টাকার বিদ্যুতের বিল। তাঁর কথায়, বুঝে নিন, গোটা রাজ্যে কত টাকার বিল বাকি থাকতে পারে।
বিদ্যুতের সমস্যা মেটাতে মালদা জেলা আদালতে ৬০ লক্ষ টাকা খরচ করে জেনারেটর বসানো হলেও, ডিজ়েলের খরচ রাজ্য না দেওয়ায় তা চালানো যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ দপ্তরের কর্তাদের বক্তব্য, আদালতের ব্যাপার, তাই নোটিস পাঠানোর বিষয়টি রাজ্যের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন।
তবে বিল বাকি রয়েছে। ২০২৪–এর ২০ সেপ্টেম্বর মালদা আদালতে ১০টি কক্ষের চারতলা কম্পোজ়িট বিল্ডিং তৈরি হয়। লোডশেডিং–য়ের মোকাবিলায় তখনই সাত লক্ষ টাকায় জেনারেটরটি বসানো হয়েছিল।
আদালতের এক কর্মীর দাবি, রাজ্য সরকার টাকা দিচ্ছে না বলে, চুক্তি ভিত্তিক অপারেটর নেওয়া হলেও ডিজ়েলের অভাবে জেনারেটরটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
অভিযোগ, বহু জেলা আদালতে পরিকাঠামোর অভাবে বিচারকদের বসার জায়গাও নেই। একাধিক বিচারককে এক ঘরে কাঠের পার্টিশন দিয়ে এজলাস ভাগ করে কাজ চালাতে হচ্ছে।
হাইকোর্ট সূত্রে খবর, ১১টি জেলায় নিম্ন আদালতের নতুন ভবন তৈরির সিদ্ধান্ত হয়ে গেলেও, রাজ্য জমি হস্তান্তর করতে পারেনি। বারাসতের মতো জেলা আদালতে তিন–চার জন বিচারকও নাকি একটি ঘর শেয়ার করে বসছেন।
মালদার মতো জেলা আদালতে ছোট্ট ঘরে দমবন্ধ পরিবেশে আইনজীবীরা গাদাগাদি করে বসতে বাধ্য হচ্ছেন। বহু জায়গায় আইনজীবীদের বসার জন্য বারের ব্যবস্থা না থাকায়, তাঁদের গাছতলাতেও বসতে হয়। নেই পর্যাপ্ত চেয়ার–টেবিলও।
অভিযোগ, পশ্চিমাঞ্চলের জেলা আদালতগুলির সরকারি আইনজীবীদের অধিকাংশ অফিসেই এসি নেই। ‘ঘড় ঘড়’ শব্দে পুরোনো ফ্যান ঘোরে। কোথাও পাঁচ, কোথাও আট বছর আগে এসির রিক্যুইজ়িশন পাঠানো হলেও তা মঞ্জুর হয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সরকারি আইনজীবীদের একাংশ বলছেন, ‘এসি তো অনেক দূর, অফিসে কেস ডায়েরি রাখার জায়গাটুকুও নেই। ঘুণ ধরা টেবিল নিয়ে চলে যেতে হচ্ছে!’
বাড়ি বাড়ি গিয়ে জমি–বাড়ি, ডিভোর্স এবং বাচ্চার কাস্টডি সংক্রান্ত সিভিল মামলার নোটিস পৌঁছে দেন ‘প্রসেস সার্ভার’–রা। অভিযোগ, প্রায় চার–পাঁচ বছর ধরে ‘প্রসেস সার্ভার’–রা টিএ (ট্রাভেল অ্যালাওয়েন্স) বিল পাচ্ছেন না।
ফলে পকেটের টাকায় বাইকে, বাসে, অটোতে গিয়ে নোটিস পৌঁছতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই সময় মতো তাই নোটিস পৌঁছচ্ছে না। অভিযোগ, টাকার অভাবে বহু নিম্ন আদালতে পরিশ্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। পরিচ্ছন্নতার অভাবে শৌচাগারের অবস্থা তথৈবচ।
উল্লেখ্য, গত ১৪ জানুয়ারি হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে শহর থেকে ট্রাম তুলে দেওয়া সংক্রান্ত এক মামলায় রাজ্য একটি প্রস্তাবের চিঠি দেয়। দেখা যায়, আগামী বছর ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপে ক্যানাডার ভ্যাঙ্কুভার সিটিতে হেরিটেজ পরিবহণ হিসেবে সাজাতে কলকাতা থেকে দু’টি ট্রাম চাওয়া হয়েছে।
সেগুলি সাজিয়ে–গুছিয়ে পাঠানোর যাবতীয় খরচ বহন করতে হবে রাজ্যকে। এই প্রস্তাব শুনে কার্যত বিস্ফোরণ হয় এজলাসে। টাকার অভাবে জেলা জজেরা যখন কার্যত ভিক্ষাবৃত্তি করে আদালত চালাচ্ছেন, তখন রাজ্য এই প্রস্তাব কী করে দেয়, তা নিয়ে খোলা এজলাসেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি।
তাঁর ক্ষোভ, রাজ্যের মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, অর্থসচিবের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে টাকা মেটানোর ক্ষেত্রে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ভবিষ্যতে তিনি ওই অফিসারদের সঙ্গে কোনও বৈঠকেও যেতে চান না বলে জানান প্রধান বিচারপতি।
জেলার বিচারবিভাগীয় প্রশাসকদের প্রশ্ন, ‘রাজ্য সরকার নিয়মিত এতগুলি আদালত থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করে। মূলত স্ট্যাম্প পেপার এবং বিভিন্ন মামলায় জরিমানা থেকে রাজ্যের এই লাভ হয়। সেই টাকা কোথায় যায় বলুন তো?’
উত্তর যিনি দেবেন, রাজ্যের সেই আইনমন্ত্রী মলয় ঘটককে ফোনে পাওয়া যায়নি। তাঁর মোবাইলে পাঠানো বার্তারও জবাব মেলেনি।