লাইভ শোয়ে মানুষ ‘খুন’? হুলুস্থুলু পড়ে গেল নিউ ইয়র্ক জুড়ে। খবর ছড়িয়ে গেল, বিশ্বের সেরা ভারতীয় জাদুকর নাকি জাদু দেখাতে গিয়ে একটি মেয়েকে মেরে ফেলেছেন! ব্যস, টেলিভিশন চ্যানেলের অফিসে ফোনের পর ফোন। জ্যাম নেটওয়ার্ক। এমনকী ২৪X৭ পূর্ব সেই যুগেও খবরটা এমন দাবানলের মতো ছড়িয়েছিল যে ওই সংবাদ মাধ্যমের অফিসেই খবর খুঁজতে পৌঁছে গিয়েছিল অন্য দেশের সংবাদ মাধ্যমও। পরের দিন কাগজ বেরোতেই রহস্যভেদ।
জানা গেল, পুরোটাই ‘ইন্দ্রজাল’। বিশ্বের অন্যতম সেরা জাদুকর পি সি সরকার (সিনিয়র)-এর ক্যারিশমা। এমন ভাবে লাইভ শোয়ে সম্মোহিত করেছিলেন দর্শকদের যে খেলা শেষ হওয়ার পরেও তাঁর অভিনয়, প্রদর্শনভঙ্গির দক্ষতায় কেউ বুঝতেই পারেননি ম্যাজিক শেষ। সজ্ঞানে সুস্থ ও সুরক্ষিত রয়েছেন তাঁর সহকর্মী। এমনই ছিল পি সি সরকার (সিনিয়র)-এর ইন্দ্রজাল।
‘ম্যাজিক’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই তার সঙ্গে সমার্থক হয়ে ভেসে আসে তাঁর নাম, তিনি জাদুসম্রাট পি সি সরকার। পুরো নাম প্রতুল চন্দ্র সরকার। শুধু ভারতের সেরা জাদুকরই তিনি নন, বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাদুকরদের মধ্যেও একজন। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তাঁর ইন্দ্রজালের মহিমা ছড়িয়ে পড়েছিল আন্ধেরি টু অস্ট্রেলিয়া, কলকাতা টু ইজিপ্ট। কী ভাবে তিনি হয়ে উঠলেন জাদুসম্রাট সে গল্পও তাঁর ম্যাজিকের থেকে কম রোমহর্ষক নয়।
মিলেনিয়াল থেকে জেন জ়ি-র কাছে উইজার্ড বা জাদুকর মানেই সিনে দুনিয়ার হ্যারি পটার। কিন্তু ফিকশন নয়, বাস্তবের মাটিতে জাদুর সম্মোহন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন রক্তমাংসের এই জাদুকর। টেলিগ্রাম-রেডিয়োর যুগে বিজ্ঞান ও তাঁর দক্ষতার মিশেলে চোখের সামনে এমন জাদুর নির্দশন দেখিয়েছেন যে অনেকে সন্দেহ করতেন, তিনি আদৌ রক্তমাংসের মানুষ নন।
পথেঘাটের মাদারির খেল নয়, ভারতীয় জাদুবিদ্যাকে বিশ্বমঞ্চে সম্মানীয় স্থানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পি সি সরকার। গোটা ভারত তথা বিশ্বের কাছে তিনি আদায় করে নেন শিল্পীর মর্যাদা। ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করতে যে শুধু জাদুকরের হাতের কাজ বা অ্যাক্টিং নয়, দৃশ্যপটেরও প্রয়োজন আছে তা প্রথম বুঝিয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রদর্শনভঙ্গি, অভিনয় দক্ষতা, ম্যানারিজমের সঙ্গে মেশে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক, থিয়েটারের কায়দায় তৈরি দৃশ্যপট, মুড অনুযায়ী স্বদেশি বাজনা ও আলোর খেলার মাধুর্য। পি সি সরকার সিনিয়রের এই স্টাইল ও প্রেজেন্টেশন-এর মায়াস্পর্শে বদলে যায় ভারতীয় জাদুর রূপ। জাদু দেখানোর সময়ে শিল্পীর মহারাজকীয় কায়দায় বেশভূষার প্রবর্তনও পি সি সরকার সিনিয়রের। সময় যত এগিয়েছে, ততই মঞ্চে তাঁর জাদুর খেলায় জুড়েছে অত্যাধুনিক জিনিস। মঞ্চে আল্ট্রা-ভায়োলেট আলোর ব্যবহারও প্রথম করেছিলেন জাদুসম্রাট।
১৯১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, পি সি সরকার, অর্থাৎ প্রতুল চন্দ্র সরকারের জন্ম হয় অবিভক্ত বাংলার টাঙ্গাইল জেলার অশোকপুর গ্রামে। গ্রামের রাস্তায় একদিন মাদারির খেলা দেখতে গিয়েই ম্যাজিকের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয়। পরে তাঁর আগ্রহ দেখে জাদুর খেলা দেখানোয় দীক্ষা দেন তাঁর এক মামা দীনেশ চন্দ্র নন্দী। সেই শুরু। ভাগ্নের বায়নায় জেরবার দীক্ষাগুরু মামাকে বানিয়েও দিতে হয়েছিল ম্যাজিকের জিনিস। তাস, রুমাল, কয়েন ইত্যাদি নিয়ে ম্যাজিক দেখাতে শুরু করা প্রতুল চন্দ্রই নিজের গবেষণা, পড়াশোনা, অধ্যবসায় ও বুদ্ধির জেরে তৈরি করেন অভাবনীয় সব জাদুর খেলা। তাঁর শান্ত-সৌম্য চেহারা, কন্ঠের দৃঢ়তা, অতিসুন্দর বাচনভঙ্গি একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলত দর্শকদের।
পি সি সরকারের একাধিক তাকলাগানো জাদুর খেলাই তাঁকে এনে দিয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি। তাঁর পুত্র, জাদুকর পি সি সরকার জুনিয়র, অর্থাৎ প্রদীপ চন্দ্র সরকারের কথায়, জাদুসম্রাটের দেখানো সেরা ম্যাজিক ছিল জিভ কেটে ফেলার খেলা।
‘এই সময় অনলাইন’-কে তিনি বলেন, ‘বাবা এই খেলাটা দেশে কখনও দেখাতেন না। বিশেষত বিদেশের মাটিতেই বরাবর দেখিয়ে এসেছেন এই স্পেল। এই জাদুর খেলায় এক জনের জিভ কেটে ফেলতেন তিনি। এতটাই ভয়ানক প্রভাব ছিল এই খেলার যে, সঙ্গে থাকতেন চিকিৎসক। যে লোকটি উপর বাবা এই জাদু দেখাতেন, সম্মোহনের মাধ্যমে তাঁর হৃদযন্ত্রকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। ম্যাজিক চলাকালীন চিকিৎসকরাও পরীক্ষা করে দেখেছেন, যাঁর জিভ কাটা হচ্ছে তাঁর হার্ট বন্ধ। কোনও স্পন্দন নেই। জাদুর মায়া কাটতেই আবার সব স্বাভাবিক!’
স্বাভাবিক ভাবেই পি সি সরকার সিনিয়রের এই শ্রেষ্ঠ জাদুর প্রদর্শন সাধারণ মানুষের থেকে একটু আড়ালেই ছিল। তবে তাঁদের কাছে সব থেকে রোমহর্ষক ছিল এক জন মানুষকে বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে কেটে দু’-আধখানা করে ফের জুড়ে দেওয়ার খেলা। এই খেলা দেখতে ভিড় করতেন দেশ-বিদেশের মানুষ।
‘অ্যাং-রে আই’ নামের এই জাদুর খেল মঞ্চে এতটাই বিশ্বাসযোগ্য ভাবে জাদুসম্রাট দেখাতেন যে অনেক দর্শক সবটা সত্যি ভেবে মাঝপথে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। কেউ আবার অসুস্থ হয়ে ম্যাজিকের মাঝেই হল ছেড়ে বেরিয়ে যেতেন। ১৯৫৬ সালে লাইভ শোয়ে এই জনপ্রিয় খেলাটি দেখাতে নিউ ইয়র্কে পি সি সরকারকে নিয়ে গিয়েছিল বিবিসি। তাদের স্টুডিওতে লাইভ সম্প্রচার করা হয় এই জাদুর খেলা। আর তাতেই ঘটেছিল বিশ্ববিখ্যাত সেই ঘটনা।
লাইভ সম্প্রচারে এমন নাটকীয়তা এনেছিলেন জাদুসম্রাট যে মেয়েটিকে কেটে জোড়ার পরেও তাঁর জ্ঞান ফেরেনি। মুখে কাঁচুমাচু ভাব রেখে এমন একটা এক্সপ্রেশন দিয়েছিলেন যেন কোনও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গিয়েছে। প্রচণ্ড উৎকন্ঠার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় লাইভের টাইম আর চ্যানেলে শুরু হয়ে যায় পরের প্রোগ্রাম। এদিকে দর্শক যায় ক্ষেপে খেলার শেষটা না দেখতে পেয়ে। আর অন্য দিকে ছড়িয়ে পড়ে জাদুসম্রাটের হাতে মেয়েটির ‘খুন’ হওয়ার খবর। এর পরের ঘণ্টা থেকে পরের দিনের খবরের কাগজ না বেরোনো পর্যন্ত টেলিফোনের জ্বালায় জেরবার হয়ে গিয়েছিল বিবিসি অফিস। সকলের একটাই প্রশ্ন, মেয়েটার কী হল? পরের দিনের কাগজে আসল ঘটনা জানা গেলে থামে আলোচনা। এই ঘটনায় গোটা বিশ্বে পি সি সরকারের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়।
পি সি সরকারের ইন্দ্রজালের গুণমুগ্ধ ছিলেন একাধিক গণ্যমান্য ব্যক্তি। শোনা যায়, অবিভক্ত বাংলার প্রধান ফজলুল হক (তখন তাঁকেই বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখা হতো) একবার সদলবলে তাঁর খেলা দেখতে এসেছিলেন। মন্ত্রীকে ডেকে তাঁকে দিয়ে ও তাঁর সঙ্গীদের দিয়েও একটি সাদা কাগজে সই করিয়ে নেন পি সি সরকার। কিন্তু, তাঁর মন্ত্রবলে সকলের চোখের সামনে নিমেষের মধ্যে সেই সাদা কাগজ হয়ে যায় ফজলুল হক-এর পদত্যাগপত্র। জাদুসম্রাটের এই ফোর্স রাইটিং-এর খেলাও ছিল দারুণ চমকপ্রদ।
তবে তাক লাগানো আরও একটি খেলা হচ্ছে, রেলওয়ে ট্র্যাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকা পি সি সরকার ঠিক ট্রেন আসার কয়েক মুহূর্ত আগে তালা খুলে, শিকল-মুক্ত হয়ে হাসতে হাসতে উঠে আসতেন। আশ্চর্যের বিষয়, ওই শৃঙ্খলটি খুলতে ১৭টি চাবি ব্যবহার করতে হতো। কিন্তু জাদুসম্রাট ঠিক তাঁর জাদুতে অসম্ভবকে সম্ভব করে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে যেতেন। এক বার এই খেলাটি মুখোমুখি দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের জাদুকর ফোরামের তৎকালীন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি উইল গোল্ড স্টোন। বলেছিলেন, ‘আপনি সাধারণ মানুষ নন, আপনি সিদ্ধপুরুষ। আপনাকে কুর্ণিশ।’
এ ছাড়া পি সি সরকারের ‘ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া’ খেলাটিও দারুণ জনপ্রিয়। বহু প্রাচীন জাদুর খেলার গুপ্তমন্ত্র তিনি নিজেই গবেষণা করে বার করেছিলেন বলে শোনা যায়। তাঁর জাদুর অভিনবত্ব ও নাটকীয়তা পি সি সরকারকে বসিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে। ১৯৩০ থেকে শুরু করে বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশে ম্যাজিক শো করেছেন পি সি সরকার। ম্যাজিকের দুনিয়ায় সর্বকালের সেরার তকমা তিনি আদায় করে নিয়েছেন। জাদুর দুনিয়ায় নিমজ্জিত ছিল জাদুসম্রাটের জীবন। তাই পদবির বানান Sarkar থেকে বদলে করে দেন Sorcar। বলেন, এর অর্থ জাদুকর।
২৩ ফেব্রুয়ারি, মহান জাদুসম্রাটের জন্মদিনই এখন গোটা বিশ্বের কাছে জাদুকর দিবস হিসেবে পরিচিত। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে অসংখ্য সম্মান ও পুরস্কার এসেছে তাঁর ঝুলিতে। ভারত সরকার জাদুসম্রাট পি.সি সরকারকে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত করে। প্রকাশ করা হয় তাঁর নামে ডাকটিকিটও। কলকাতা পুরসভা শহরের একটি রাস্তার নামও রেখেছে তাঁর নামে, জাদুসম্রাট পি সি সরকার সরণি।
ম্যাজিকই ছিল জীবন। মঞ্চে জাদুকরের পোশাক পরে দাঁড়ালে তিনি যেন হয়ে যেতেন একেবারে অন্য মানুষ। তাই শরীর খারাপ থাকা সত্ত্বেও জাদুর খেলা দেখানোর মোহ তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। ডাক্তারের নিষেধ না মেনেই চলে যান বিদেশ সফরে। ১৯৭১ সালের ৬ জানুয়ারি জাপানের জিগেৎসু শহরে ছিল তাঁর শো। সেই শেষ। মাত্র ৫৭ বছর বয়সে প্রিয় ম্যাজিকের মঞ্চে ইন্দ্রজাল বোনার মাঝেই মৃত্যু হয় পি সি সরকারের। তাঁর এই কর্মকাণ্ডকে আজও মঞ্চে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁর পুত্র প্রদীপ চন্দ্র সরকার ওরফে পি সি সরকার (জুনিয়র)। দুর্দান্ত ম্যাজিকে পারদর্শী তাঁর নাতনিরাও।