সত্যিই মেয়েরা বক্সঅফিসে প্রভাব ফেলেন না? তা হলে পুরুষেরাই একা কাজ করে ফাটিয়ে দিতেন: জয়া
আনন্দবাজার | ১৮ জুন ২০২৫
পুরনো শাড়ির গন্ধ, শাড়ির ভাঁজ আর জয়া আহসান। তাঁর শরীর, মন জানে পুরনোকে আগলে রাখতে। পুরনো দিনের মানুষগুলোর প্রতিও তাঁর অদ্ভুত টান। মায়ের চেয়ে পুরনো দিদাও তাঁর মা! কলকাতায় এক বৃষ্টি পড়া দিনে শুরু হল আনন্দবাজার ডট কমের সঙ্গে পুরনো কথা ও নতুন ছবির গল্প।
প্রশ্ন: প্রথম কবে শাড়ি পরেছিলেন মনে আছে?
জয়া: (একটু ভেবে) একদম প্রথম শাড়ির কথা মনে নেই। মনে আছে, প্রথম কবে শাড়ি কিনে দেওয়া হয়েছিল। একটা সময় পর্যন্ত হয় না, মায়ের শাড়ি নিয়ে পরছি। দিদির শাড়ি নিয়ে পরছি। সেই প্রথম আমার জন্য একটা শাড়ি কেনা হল! তখন আমি সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণি। আমার নানু মানে দিদিমা টাঙ্গাইল থেকে শাড়ি কিনে দিল। সে দিন প্রথম মনে হল, অফিসিয়ালি আমি বড় হয়ে গিয়েছি।
প্রশ্ন: শাড়িটা আছে?
জয়া: হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে। সব আলাদা করে রেখে দিই।
প্রশ্ন: তাই?
জয়া: হ্যাঁ, আমার তো খুব খারাপ অভ্যাস।
প্রশ্ন: কেন?
জয়া: আমার ওয়ার্কিং ক্লসেটে একদিকে শুধুই সারি সারি পুরনো শাড়ি। আমি পুরনো কিছুই ফেলতে পারি না! ক্লসেটে নতুন কিছু যোগ হলে পুরনোটা বের করে দেওয়া উচিত। যাঁদের প্রয়োজন তাঁদের দিয়ে দেওয়া যেতে পারে বা অন্য কিছুও বানানো যেতে পারে। আমার এত মায়া সবেতে! পুরনো গন্ধ, শাড়ি-জামার ভাঁজ দেখতে দেখতে সেই সময়ে পৌঁছে যাই।
প্রশ্ন: শাড়ি ছাড়া আর কী রেখেছেন?
জয়া: সব সব। আমার প্রথম দুল এখনও যত্নে আমার কাছে রাখা আছে। ছোট ছোট কানের দুল যে গুলো এখন ব্যবহার করি সে গুলো কত পুরনো।ছোট্ট ছোট্ট ঝুমকো। কি একটা খুঁজতে গিয়ে সে গুলো হঠাৎ পেলাম। ওটাও আমায় দিদিমা দিয়েছিল। আমার সব কিছুতে দিদিমার একটা বড় ভূমিকা। আমার ফ্রেন্ড, ফিলোজ়ফার, গাইড। প্রায়ই মনে হয়, মায়ের পাশাপাশি দিদাকেও যদি মা ডাকতে পারতাম। শুধুই কি বায়োলজিক্যাল মা-ই মা হয়? দিদা আমার ছোটবেলা মায়ায় ভরে দিয়েছিল।
প্রশ্ন: মনে হয়, আপনার ছোটবেলা সহজ ছিল? মুঠোফোন আসায় সহজ শৈশব হারিয়ে গেল?
জয়া: এটা সত্যি প্রভাব ফেলে। মানুষের মূল্যবোধ, মানুষের জীবন যাপন ধীরে ধীরে বদলে যায়। অনেক কিছু নতুন যোগ হয়। আবার অনেক কিছু চলে যায়। যা তার কাছে থেকে চলে যাচ্ছে সে সব থেকেই তো মূল্যবোধ তৈরি হয়। আমার মনে হয় সন্তান বা বাচ্চার ক্ষেত্রেও সে রকম। তবে যতই প্রযুক্তির মধ্যে দিয়ে শিশু বড় হোক, একটা সময়ের পরে সে কিন্তু মায়ের পক্ষ নেয়। মায়ের পক্ষে দাঁড়ায়।
প্রশ্ন: ঠিক দাঁড়ায়, না?
জয়া: হ্যাঁ, ঠিক দাঁড়াবেই। মায়ের প্রতি টানটা সে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করে।
প্রশ্ন: ঠিক যেমন আপনি আর আপনার মা! আপনারা ভীষণ ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে...
জয়া: আমাদের সংসারে আমাদের মা সূর্য। মায়ের সংসারে শুধুই যে সন্তানে সীমাবদ্ধ তা নয়। পোষ্যরা আছে। পরিচারিকারা আছেন। এঁরাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। (একটু থেমে), মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা দেখাতে চাই না। দুর্বল হয়ে পড়ি।
প্রশ্ন: তাই ?
জয়া: আমি যে শারীরিক ভাবে মায়ের খুব কাছাকাছি, তা নই। মাকে কখনও বলিনি, আমি তোমাকে ভালবাসি। মাকে ডেকে কখনও আবার দুঃখপ্রকাশও করিনি। কেমন যেন লাগে! অথচ পৃথিবীর সকলের কাছে বলতে পারি ‘সরি’।
প্রশ্ন: মাকে বলা যায় না?
জয়া: না! আমার কেমন যেন লজ্জা লাগে। ইদের দিন সবাইকে সালাম করছি। মাকে সালাম করতে ভুলে যাই বা করি না।
প্রশ্ন: আর ‘ডিয়ার মা’?
জয়া: ডিয়ার মা’ মানে মাতৃত্ব, মা-মেয়ের সম্পর্ক। পরিচালক অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী সন্তান দত্তক নেওয়ার ঘটনার মোড়কে থ্রিলারের গল্প বলেছেন।
প্রশ্ন: আপনার চোখে সন্তান দত্তক নেওয়া বিষয়টি কী রকম?
জয়া: সবাইকে বা সব সময় বায়োলজিক্যাল মা হতে হবে, এমন তো কোনও কথা নেই। যদিও তার পরেও আমাদের সমাজ এখনও এই বিষয় ততটা উদার চোখে দেখে না। রক্ত, বংশ নিয়ে ভাবে।
সন্তান দত্তক নেওয়ার মতো সংবেদনশীল বিষয়টিই ‘ডিয়ার মা’-তে তুলে ধরা হয়েছে। পরিচালকের বক্তব্য, ভালবাসা রক্তের সম্পর্কের থেকেও গাঢ়। কী করে সেটা বলছি, সেটাই দর্শক পর্দায় দেখবেন। আপনিই বলুন না, দত্তক নেওয়া কি এখনকার দিনে কোনও বড় ব্যাপার? যিনি সন্তান ধারণ করতে চান তিনি সেটাই করবেন। তার পরেও যদি কেউ সন্তান চান তিনি দত্তকের মাধ্যমে সেই ইচ্ছাপূরণ করতে পারেন। আজকের দায়িত্বশীল নাগরিকের সেটাই করা উচিত। বহু সন্তান আছে যারা ঘর পায় না, মা-বাবা পায় না। ওদের আপন করে নিলে আমাদের সন্তানের সঙ্গে ওই মানুষগুলো মিলে যাবে। সমাজে সমানাধিকার বাড়বে।
প্রশ্ন: ছবিতে আপনার চোখ বারে বারে কথা বলেছে...
জয়া: আসলে চিত্রনাট্যেই ও রকম ছিল। চিত্রনাট্যকার শাক্য অসাধারণ লিখেছেন। গল্পের ভাবনা তো অনিরুদ্ধদা মানে টোনিদার। টোনিদার কাজ মানে যত্নের কাজ। আর চিত্রগ্রাহক, পোশাক পরিকল্পক, রূপসজ্জাশিল্পীরা তো আছেনই। সকলে মিলে আমায় তৈরি করে দিয়েছেন। এই ছবি মানুষকে নতুন করে ভাবাবে। ছবিতে শিশু শিল্পীরাও ভাল কাজ করেছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে কাজের অবস্থা কেমন?
জয়া: হ্যাঁ, বেশ কিছু কাজ হচ্ছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমার প্রথম সিরিজ় ‘জিমি’ মুক্তি পেল। ঢাকায় আমার প্রযোজিত একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। ইদে মুক্তি পেল ‘তাণ্ডব’, ‘উৎসব’। দুটো ছবিতেই বাংলাদেশের তারকা অভিনেতারা অভিনয় করেছেন। ইদকে ঘিরে অনেক কাজ হয়েছে আমাদের দেশে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে কি শুধুই শাকিব খানের শাসন? ওঁর প্রভাবে ঢালিউডের বিনোদন দুনিয়া অনেকটাই আচ্ছন্ন...
জয়া: শাকিব নিজেই উন্নতি করেছেন। অসংখ্য অনুরাগী। তাঁরা শাকিবকে মন থেকে ভালবাসেন। দেখুন, জীবনে ঝঞ্ঝাট, ঝামেলা থাকবেই। এগুলোর উত্তর না দিয়ে শাকিব নিজের কাজ দিয়ে সব কিছুর জবাব দেন। আমি নিজে সেটা দেখেছি। ও-ও আমার মতো কর্মে বিশ্বাসী। এই জায়গায় আমি ওঁকে শ্রদ্ধা করি।
প্রশ্ন: বলিউড, টলিউড বা ঢালিউড— এখনও পুরুষশাসিত...
জয়া: এটা ঠিক। এটাই আমাদের সমাজব্যবস্থা। তার প্রভাব ইন্ডাস্ট্রিতেও পড়ে। আরও একটা কথা বলি, আমরা যাকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বলি সেই সমাজকে কিন্তু অনেক নারীও সমর্থন করেন। তাঁরা পুরুষের চোখ দিয়ে সমাজকে দেখেন। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ— যেখানেই যান দেখতে পাবেন। যদিও এই সমাজব্যবস্থা কাম্য নয়। আমরা আমাদের কাজের মাধ্যমে যতটা এ বিষয়ে সরব হওয়া যায় চেষ্টা করি।
প্রশ্ন: পরিচালকেরা আজকাল নিজেদের বিষয় সরব , বলেন তাঁরা দারুণ কাজ করেন। তাঁদের কাজ অন্য রকম, আলাদা। কী বলবেন?
জয়া: (হেসে ফেলে) আমরাও তো বলি। ছবিটা বেশ অন্য রকম। তার পরেও বলব, সৌভাগ্যবশতঃ সত্যিই কিছু অন্য রকম চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছি। ভাল পরিচালকদের পরিচালনায় কাজ করেছি।
প্রশ্ন: ছবিতে গল্প বলা কমে আসছে?
জয়া: একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসাবে স্বীকার করতেই হয়, গল্প বলার জায়গায় কমে গিয়েছে। অভিনেতারা সংখ্যায় কমে গিয়েছি। একই চেহারা বার বার দেখছেন দর্শক।
প্রশ্ন: অভিনেতার সংখ্যা কেন কমে গিয়েছে? কিছু নতুন মুখ এসেছিলেন, তাঁরা যেন কোথায় হারিয়ে গেলেন...
জয়া: আমরা আসলে কেউ জায়গা ছাড়তে জানি না। আমাদেরকেও জায়গা ছাড়তে হবে। আমি যে ছবি দুটো ছবি প্রযোজনা করেছি সেখানে দু’জন নাতুন অভিনেত্রী এনেছি। আমাদের আরও চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। বড্ড শর্টকার্ট রাস্তায় গিয়ে শিওর শট খেলার চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন: যেমন ধরে নেওয়া হয়, ইনি নামকরা অভিনেত্রী, বক্সঅফিস আছে...
জয়া: সুতরাং এঁকেই নিতে হবে। অভিনেত্রী আমাদেরই তৈরি করতে হবে। বক্সঅফিস আমরা তৈরি করব। শুধু মাত্র পুরুষকেন্দ্রিক কাজ কেন হবে? সত্যিই কি মেয়েরা বক্সঅফিসে কোনও প্রভাব ফেলেন না! তা হলে তো পুরুষেরাই একা কাজ করে ফাটিয়ে দিতেন। নারীকেন্দ্রিক ছবি হোক। সে গুলোকে আরও বড় করে বানাক। দু’তিন জন, চার জন অভিনেত্রী মিলে একটি ছবিতে অভিনয় করুন। টোনিদার এই ছবিতে আমার একটা জিনিস ভাল লাগল, পটভূমিকায় বাংলাদেশ রয়েছে। বাংলায় কাজ। কিন্তু তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে, মুম্বই থেকে অভিনেত্রীদের নিয়ে এসেছেন। উনি সব সময় এই সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করেন। শুধু এই ছবিতে নয়, ওঁর প্রত্যেক ছবিতেই এই চেষ্টা থাকে। চুপচাপ এই কাজগুলোই করে যান। এটাই করা উচিত। মুখে বেশি কিছু না হলে আমাদের কাজ করে দেখানো উচিত।
প্রশ্ন: মনে হয় না, বাংলা ছবিতে হয় গোয়েন্দা নয় সিক্যুয়েল...
জয়া: হ্যাঁ, হচ্ছে। এগুলো কিছু কিছু হবেই। পাশাপাশি, পরীক্ষা-নীরিক্ষামূলক কাজও করতে হবে। গল্প ঠিকমতো বানাতে পারলে দর্শক কেন দেখবে না? উপমহাদেশে সব ধরনের ছবি, সব ভাষার ছবি দর্শক দেখতে পাচ্ছে। ছবির বিষয় ভাল না হলে এখন আর কেউ সেই ছবি দেখবে না। এটা আমাদের ব্যর্থতা, আমরা দর্শকদের ভাল ছবি দেখাতে পারছি না। বাংলায় নতুন কিছু তৈরি করে দেখাতে হবে। চলচ্চিত্র উৎসবগুলোয় ছবি পাঠাতে হবে। এ ভাবেই বাংলা ভাষায় তৈরি ছবিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন: জয়া আবার কবে সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি করবেন, এই আগ্রহ কিন্তু কলকাতার দর্শকদের আছে...
জয়া: কৌশিকদার ‘অর্ধ্বাঙ্গিনী ২’র শুটিং শুরু হল। বাকি পরিচালকদের সঙ্গেও নিশ্চয়ই কাজ হবে। আসলে দুই বাংলায় মিলিয়ে কাজ করি তো। ফলে, ধীরেসুস্থে এগোতে ভালবাসি।
প্রশ্ন: ব্যক্তি সম্পর্কের জটিলতা বেড়েছে আরও, মনে হয় আপনার?
জয়া: এখন তো কেউ রিলেশনশিপেই যায় না! সিচুয়েশনশিপ... আর কী কী যেন আছে? এ সব ভাবনায় সব কিছুই আছে। শুধু রিলেশনশিপটাই নেই।
প্রশ্ন: বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটাই কি পুরনো হয়ে গেল?
জয়া: ওগুলো তো ‘ওল্ড স্কুল’। যাই হোক, এই জিনিসগুলো আসবে। আবার ঘুরে আসবে। তবে পৃথিবীতে যত রকম মানুষ তত রকম সম্পর্ক। কোনও সম্পর্কই কোনও সম্পর্কের সঙ্গে মেলে না। আমার প্রত্যেকটি ফেলে আসা সম্পর্কও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সেই সম্পর্কগুলো নিয়েই আজকের আমি। সব ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যায় না। ভুলটুকুও তো আমার! সেটা মেনে সামনের দিকে চলা।