রূপক মজুমদার, বর্ধমান
এ যেন কোনও ওয়েব সিরিজ়ের রুদ্ধশ্বাস চিত্রনাট্য। যার নেপথ্যে এক অপরিচিত ব্যক্তি। তাঁকে ঘিরেই এই বিপুল আর্থিক কেলেঙ্কারির নকশা তৈরি হয়েছিল। তাঁর নাম সুব্রত দাস।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিভাগ থেকে অধ্যাপকমণ্ডলী, সকলেই এই প্রশ্নই করছেন। তদন্তে উঠে আসছে, আর্থিক বেনিয়ম হয়েছে এই ব্যক্তিকে ঘিরেই।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিক্সড ডিপোজ়িট আগে ছিল পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের স্টেশন বাজার জেলখানা মোড়ের শাখায়। সেখান থেকে ওই ফিক্সড ডিপোজ়িটের টাকা পাঠানো হয় ব্যাঙ্ক অফ বরোদার যাদবপুর শাখায়।
তার অ্যাকাউন্ট নম্বর ৫৭১৭০১০০০০১৮৯৩। ওই অ্যাকাউন্ট সুব্রতর নামে। তিন ধাপে অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকেছিল। প্রথম দু’টি পর্বে টাকা ঢোকে ২০২২ সালের ১২ এবং ২৬ অগস্ট। তৃতীয় দফায় টাকা ঢোকে ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ। তিন ধাপে ওই অ্যাকাউন্টে ঢোকে ১ কোটি ৯৩ লক্ষ ৮৯ হাজার ৮৭৬ টাকা।
প্রশ্ন, পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে জমা রাখা ফিক্সড ডিপোজ়িট মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরে সেই টাকা কেন যাদবপুর শাখার ব্যাঙ্ক অফ বরোদার বিশেষ নম্বরের সেভিংস অ্যাকাউন্টে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল?
নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন রেজিস্ট্রার ও ফিনান্স অফিসার। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা এ ভাবে কি ব্যক্তিগত কোনও অ্যাকাউন্টে পাঠানো যায়, প্রশ্ন তুলেছেন কমিটির সদস্যরা।
এই বিশেষ অ্যাকাউন্টে টাকা ঢোকার বিষয়টি জানতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স বিভাগের কর্মী ভক্ত মণ্ডল এবং এনামুল হক। জানতেন আরও এক আধিকারিক। সূত্রের খবর, বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ডেন জুবিলি বিল্ডিংয়ের ফিনান্স বিভাগের অফিসে নিয়মিত যাতায়াত ছিল সুব্রতর।
কিন্তু তিনি কে? উত্তর এখনও অজানা। তিনি কি কোনও ঠিকাদার? তা-ও জানেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী থেকে অধ্যাপকেরাও।
তবে সকলেই জানেন, ওই ব্যক্তির বাড়ি কল্যাণী এলাকায়, যেখানে থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য নিমাইচন্দ্র সাহা! অনেকেই সেই সমীকরণ দেখে দুয়ে দুয়ে চার মেলাচ্ছেন।
সিআইডির জেরার মুখে নিমাই নিজেকে নিরপরাধ বললেও তথ্য কিন্তু অন্য কথা বলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তী উপাচার্য গৌতম চন্দ্রর নির্দেশে তৈরি হওয়া প্রথম তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক অরিন্দম গুপ্ত।
পরবর্তী সময়ে কলা বিভাগের ডিন অধ্যাপক প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৈরি হয় দ্বিতীয় কমিটি। দু’টি তদন্ত কমিটির রিপোর্টে পেমেন্ট অ্যাডভাইজ়ারির অপব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
অর্থনীতির অধ্যাপক ভাস্কর গোস্বামীর প্রশ্ন, ‘এই সুব্রত কে, তা জানা দরকার। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই তিনি একজন ঠিকাদার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সাপ্লাই করেছেন, তার তথ্যপ্রমাণ কোথায়?’ তাঁর সংযোজন, ‘তার থেকেও বড় প্রশ্ন, কী ভাবে এত টাকা একজন ব্যক্তির সেভিংস অ্যাকাউন্টে দেওয়া হলো? কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ছাড়া এই সমস্ত লেনদেন কখনওই সম্ভব নয়।’
কলকাতা হাইকোর্টে মামলাকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহ-রেজিস্ট্রার দেবমাল্য ঘোষ বলছেন, ‘আমরা শুনছি প্রাক্তন উপাচার্য দাবি করেছেন কিছু জানেন না, সব জানে ফিনান্স বিভাগ। তা হলে এ-ও তো প্রমাণ হচ্ছে, উপাচার্য হিসেবে তিনি কোনও নজরদারি করেননি।’
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শ্যামাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘আমরা চাই সিআইডি তদন্ত করে দোষীদের গ্রেপ্তার করুক। আধিকারিক হোন বা কর্মচারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থইকেই আমরা প্রাধান্য দেবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের গচ্ছিত অর্থ কেউ আত্মসাৎ করবেন আর আমরা চুপ থাকব, এমন ভাবার কারণ নেই।’