• বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক কেলেঙ্কারি: জেনেশুনেই হয়েছে বিপুল লেনদেন
    এই সময় | ২১ জুন ২০২৫
  • রূপক মজুমদার, বর্ধমান

    বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনার কথা জানিয়ে পূর্ব বর্ধমান জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপারকে চিঠি দিয়েছিলেন পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের বর্ধমান স্টেশন বাজার শাখার সিনিয়র ম্যানেজার পিনাকী বিশ্বাস।

    ২০২৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার কথা উল্লেখ রয়েছে দু’টি তদন্ত কমিটির রিপোর্টেই। সেখানে তাঁরা ভক্ত মণ্ডল ও সুব্রত দাসের নামে সরাসরি অভিযোগ জানিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠছে, আগে কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ জানানো হলো না?

    তদন্ত কমিটির রিপোর্টে প্রশ্ন করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স অফিসার সৌগত চক্রবর্তী এই বিষয়ে তৎকালীন উপাচার্য নিমাইচন্দ্র সাহার সঙ্গে কোনও আলোচনা করেছিলেন কি না, করে থাকলে তার কোনও তথ্যপ্রমাণ তাঁর অফিসে পাওয়া যায়নি কেন?

    একইসঙ্গে তদন্ত কমিটি প্রশ্ন তুলেছে ফিনান্স অফিসারের হেফাজতে থাকা ফিক্সড ডিপোজ়িটের কাগজ কী ভাবে অন্যের হাতে গেল তা নিয়েও।

    সূত্রের খবর, ব্যাঙ্কের সিনিয়র ম্যানেজার পিনাকী বিশ্বাসের করা অভিযোগের প্রেক্ষিতে বর্ধমান থানার পুলিশের একটি দল ২০২৪ সালের ১২ মার্চ দক্ষিণ ২৪ পরগনার স্বরূপনগর থানার চারহাট এলাকা থেকে সুব্রত দাসকে গ্রেপ্তার করে। ধৃতকে সিজেএম আদালতে হাজির করে নিজেদের হেফাজতে নেয় পুলিশ।

    জানা গিয়েছে, পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে সুব্রত বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক কেলেঙ্কারির এই চক্রে ভক্ত মণ্ডল–সহ বেশ কয়েকজনের নামের কথা পুলিশকে জানিয়েছে। পরে এই কেসের তদন্তভার সিআইডির হাতে গেলে সিআইডি নিজেদের হেফাজতে নেয় সুব্রতকে।

    সূত্রের খবর, সেখানেও সুব্রত এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জন আধিকারিকের নাম-সহ ভক্ত মণ্ডলের জড়িত থাকার কথা জানায়।

    দু’টি কমিটির রিপোর্টেই স্পষ্ট, পেমেন্ট অ্যাডভাইজ়ারির অপব্যবহার হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আর্থিক ও প্রশাসনিক কাজগুলি একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। অবনতির জন্য শুধু অর্থ বিভাগকে দায়ী করা যাবে না।

    উপাচার্য নিমাইচন্দ্র সাহা-সহ তৎকালীন কর্তৃপক্ষ এর দায় এড়াতে পারেন না। অরিন্দম গুপ্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, আর্থিক অব্যবস্থার ক্ষেত্রে তৎকালীন উপাচার্য কেন কোনও ব্যবস্থা নেননি?

    দেখা গিয়েছে, প্রাক্তন উপাচার্য সময়মতো অডিট এবং অ্যাকাউন্টস রিপোর্ট জমা এবং অন্যদের জানার জন্য আর্থিক অনিয়মের সত্যতা প্রকাশ করেননি। আর এই জায়গা থেকেই হাইকোর্ট কম্পোট্রলার অ্যান্ড অডিট জেনারেলকে (ক্যাগ) তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ। আগামী ৩০ জুন ক্যাগ, সিআইডি ও ইডি–কে রিপোর্ট জমা করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

    নিমাইচন্দ্র সাহা উপাচার্য থাকার সময়ে পাঁচ ব্যক্তি আরটিআই করে জানতে চেয়েছিলেন, কে এই সুব্রত দাস? কেনই বা তাঁর অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়া হচ্ছে? উত্তর দেননি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

    প্রতারণামূলক লেনদেন পেমেন্ট অ্যাডভাইজ়ারির সিস্টেমকে ব্যবহার করেই করা হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে অরিন্দম গুপ্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে।

    ফিনান্স বিভাগের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, ১৬ অগস্ট প্রথম লেনদেনের সময়েই নিমাইয়ের কাছে নোট পাঠানো হয়েছিল। সেখানে ব্যাঙ্কে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, তার কপি পাঠানো হয়। কমিটি মনে করছে, এনামুল হক ক্রেডিট নোটের বাহক মাত্র।

    বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ভাস্কর গোস্বামীর কথায়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ আরটিআই করে তথ্য জানতে চাইছেন, অথচ তার উত্তর দেওয়া হচ্ছে না! অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, তথ্য গোপন করতে চেয়েছে তৎকালীন উপাচার্য। আরও বড় প্রশ্ন, যদি সত্যিই তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি না-জেনে থাকেন, তা হলে কেন আরটিআইয়ে ওঠা প্রশ্নের তদন্ত হলো না?’

    স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার কিশলয় বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, ‘প্রথমত এত টাকা পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে জানানো উচিত ছিল।

    এ ক্ষেত্রে অনেক সময়ে ব্যাঙ্ক ম্যানেজার নিজেও ফোন করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে থাকেন। কারও সেভিংস অ্যাকাউন্টে এ ভাবে কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানের এত টাকা দেওয়া হয় না, যদি না কোনও বিশেষ নির্দেশ থাকে।

    তেমন কিছু হয়েছিল কি না, খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন।’ তদন্ত কমিটির সদস্যরাও উল্লেখ করেছেন, পেমেন্ট অ্যাডভাইজ়ারি না-থাকলে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে এই জালিয়াতি আদৌ ঘটত না।

  • Link to this news (এই সময়)