দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বাঁকুড়া
খবরের কাগজ খুলে মাইক্রোফোনের সামনে মুখ রেখে একের পর এক খবর পড়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে তা মন দিয়ে শুনছেন ৬০–৭০ জন শ্রমিক। দুপুরে বাঁকুড়া শহরের রবীন্দ্র সরণি এলাকার কোঅপারেটিভ বিড়ি কারখানায় গেলে রোজ এই ছবি দেখা যায়। এই রেওয়াজ চলে আসছে প্রায় ৭০ বছর ধরে।
বাঁকুড়া শহরের বুকে এই বিড়ি কারখানা ব্রিটিশ আমলের। স্বাধীনতার পরে ১৯৫৬ সালে ব্রিটিশ আমলের নাম পাল্টে কারখানার নতুন নাম হয় বাঁকুড়া বিড়ি শিল্পী কোঅপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড।
তখন শ্রমিকদের মধ্যে দেশ-দুনিয়ার খবর জানার প্রবল আগ্রহ দেখে সংবাদপত্র থেকে খবর পড়ে তাঁদের শোনানোর এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কারখানারই এক বয়স্ক শ্রমিককে দিয়ে হয়েছিল শুরুটা। তাঁর মৃত্যু হলে খবর পড়া থেমে থাকে বহু দিন।
এর পরে শুরু হয় নতুন লোকের খোঁজ। সেই দায়িত্ব পান রবীন্দ্র সরণিরই বাসিন্দা পশুপতি নাগ। সেটা ছিল ১৯৮২ সাল। পশুপতি তখন ১৭ বছরের কিশোর। সেই থেকে আজও রোজ নিয়ম করে এই বিড়ি কারখানায় খবর পড়েন তিনি। কারখানার শ্রমিকদের কাছে তাঁর পরিচয় ‘খবরবাবু’।
রোজ দুপুর একটা বাজলেই কারখানায় হাজির হয়ে যান পশুপতি। সেখানে তাঁর জন্য ব্যবস্থা রাখা হয় একটি চেয়ারের আর মুখের সামনে থাকে মাইক্রোফোন। বিভিন্ন সংবাদপত্র খুলে পাতার পর পাতা উল্টে একের পর এক খবর পড়তে থাকেন তিনি।
কাগজে বিশেষ কোনও বিজ্ঞাপন চোখে পড়লে সেটিও শ্রমিকদের পড়ে শোনান খবরবাবু। কারখানা ছুটি থাকলে সেক্ষেত্রে পরের দিন একসঙ্গে দু’দিনের সংবাদপত্র পড়ে শোনান। দেখতে দেখতে তাঁর খবর পড়ার কাজের বয়স হলো ৪৩ বছর।
সে দিনের ১৮ বছরের পশুপতি নাগ এখন ৬০ পেরিয়েছেন। বিয়ে করেননি। বাড়িতে রয়েছেন বৃদ্ধা মা ও অবিবাহিতা দুই বোন। পশুপতি গৃহশিক্ষকতা করেন। সেই সঙ্গে রোজ দুপুরে এক ঘণ্টা খবর পড়ে শোনান বিড়ি কারখানার শ্রমিকদের।
এই খবর পড়ার জন্য তাঁর পারিশ্রমিকের ব্যাপারটিও বেশ মজার। কেমন তা? খোলাখুলিই পশুপতি বললেন, ‘খবর পড়া শেষ হয়ে গেলে প্রত্যেক শ্রমিক আমার হাতে সাতটি করে বিড়ি তুলে দেন।
সব মিলিয়ে চারশোর কিছু বেশি বিড়ি রোজ পাই। সেই বিড়ি আবার কারখানা কর্তৃপক্ষই নিয়ে নেন। বিনিময়ে দৈনিক প্রায় ১০০ টাকা পাই। এটাই আমার রোজকার পারিশ্রমিক।’
কারখানার শ্রমিক সন্ন্যাসী গড়াই, বাবলু রায়, অসিত বাগদি, গোপাল দাস, স্বপন বাগদি প্রমুখ বললেন, ‘খবরের কাগজ পড়ার সময় পাই না। পশুপতিদাই রোজ এসে খবর পড়ে শোনান। তাতে আমাদের অনেক অভিজ্ঞতা হয়। কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, আমরা জানতে পারি।’
বাঁকুড়া বিড়ি শিল্পী কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের সভাপতি মোহন গড়াই বললেন, ‘কারখানায় খবর পড়ার এই রেওয়াজ চলে আসছে ১৯৫৬ সাল থেকে। এর ফলে উপকৃত হন শ্রমিকরা। কাজের ব্যস্ততার মাঝেই দেশ-দুনিয়ার খুঁটিনাটি খবর জেনে যান তাঁরা।’