• হাকিমপুরে সুরক্ষার নামে হেনস্তা করছে বিএসএফ! প্রশাসনের কাছে অভিযোগ, আতঙ্ক ১০ গ্রামে
    প্রতিদিন | ২৩ জুন ২০২৫
  • গোবিন্দ রায়: প্রতিবেশী দেশে অশান্তির আগুন লাগতেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে পাহারা কঠোর করার নির্দেশ এসেছিল সর্বোচ্চ মহল থেকে। আর সীমান্ত সুরক্ষার সেই কড়াকড়ির জেরে ঘুম ছুটেছে উত্তর ২৪ পরগনার হাকিমপুরবাসীর। উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরের হাকিমপুর সীমান্ত। ওপারে যশোর জেলার ভাদিয়ালি গ্রাম। মাঝে বয়ে চলেছে সোনাই নদী। যত সমস‌্যা এখানকার বিথারি-হাকিমপুর সীমান্ত চৌকি নিয়ে। হাকিমপুর ও বিথারি গ্রামবাসীদের অভিযোগ, পাহারার নামে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ‘জিরো এরিয়া’ বা নো ম‌্যানস ল‌্যান্ড থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই চৌকিতে শরীর ও ব‌্যাগপত্র পরীক্ষার বাড়াবাড়ি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। তা এতটাই যে এখানকার স্কুল থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে বদলি নিয়ে অন‌্যত্র চলে যাওয়ার ঢল নেমেছে। ডকে উঠেছে ব‌্যবসাপাতিও। আবার গায়ের জোরে এই চেকপোস্ট অন্যের জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে বলেও অভিযোগ। স্থানীয় আব্দুর রউফ গায়েন ও সোহরাব সরদারের জমিতে বেআইনিভাবে জোর করে ওই চেকপোস্ট করা হয়েছে বলে অভিযোগ এনে কলকাতা হাই কোর্টে মামলাও দায়ের হয়েছে। চলতি মাসেই এই মামলার শুনানি হওয়ার কথা।

    স্থানীয় সূত্রে প্রকাশ, হাকিমপুর সীমান্তে যাবতীয় অশান্তির সূত্রপাত বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে। ওদেশে নতুন সরকার গঠন ও ভারত বিরোধিতার বাড়বাড়ন্তে সীমান্তঘেঁষা এলাকায় নজরদারি কয়েকশো গুণ বাড়িয়েছে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ১৪৩ নং ব্যাটেলিয়নের জওয়ানরা। আর তারই জেরে জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে বলে বিথারি গ্রামবাসীদের অভিযোগ। অভিযোগ, চেকিংয়ের নামে বাড়াবাড়ির জেরে এবারের ইদের উৎসব ভালো করে পালন করাই যায়নি।

    বিএসএফের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে সকাল থেকে দিনভর, মধ্যরাতেও প্রশাসনের কাছে ভিড় জমাচ্ছে সীমান্তের মানুষ। অভিযোগের ঠেলায় ঘুম উড়েছে স্বরূপনগর থানার ওসি অরিন্দম হালদারের। অভিযোগ গিয়েছে ডিএম, এসডিও, বিডিও, এসপি এমনকী মানবাধিকার কমিশনের কাছেও। এ প্রসঙ্গে স্বরূপনগরের বিডিও বিষ্ণুপদ রায় জানান, ‘‘চেকিং নিয়ে গ্রামবাসীদের নিত্যদিনের অসন্তোষের অভিযোগ রয়েছে। সমাধান সূত্র খুঁজতে বিএসএফ আধিকারিকদের পাশাপাশি বিথারির ১০টি গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য, প্রধান, উপপ্রধান এবং স্থানীয় বিশিষ্ট মানুষজনকে নিয়ে বৈঠকে বসা হয়েছিল। সেখানে কিছু বিষয় উঠে আসে। তা নিয়ে একটা রেজোলিউশন আনা হয়েছে। এখন কতটা সমাধান হয়, তা দেখা যাক!” হাকিমপুর মাঝের পাড়ায় এই চেকপোস্টের ওপাশে তাঁরালি দক্ষিণপাড়া, মাঝেরপাড়া, উত্তরপাড়া, হাকিমপুর দাসপাড়া, ঘোষপাড়া, মাঝেরপাড়া-সহ ১০টি ভারতীয় গ্রামে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বাস।

    অভিযোগ, সারা বছর ধরেই গ্রামবাসীদের উপর চেকিংয়ের নামে এই হেনস্তা চলে। ছাড় নেই গ্রামের মেয়ে-বউ বা শিশুদেরও। শুধু গ্রামবাসীরাই নন, চেকিংয়ের আওতা থেকে রেহাই পান না বাইরে থেকে আসা সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলির বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। কলকাতা থেকে প্রতিদিন হাকিমপুর হাই স্কুলে ভূগোল ও বিজ্ঞান পড়াতে আসেন যথাক্রমে সুবোধ প্রামাণিক ও মীরা বসু। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘এটা রোজকার সমস‌্যা। বিএসএফ পরিচয়পত্র দেখে, মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও নিস্তার দেয় না। আড়ালে নিয়ে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা করে। ‌স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তিতে পড়তে হয়।’’ বিএসএফের এই ‘চেকিং’-এর নামে হেনস্তার জেরে অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকাই এখানকার স্কুলগুলি থেকে বদলে নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন বলে স্থানীয় একাংশের বক্তব‌্য।

    ছাড় নেই পড়ুয়াদেরও। স্কুলব্যাগ থেকে তেমন মনে হলে জামা-কাপড় খুলিয়ে পর্যন্ত তাদের পরীক্ষা করা হয় বলে অভিযোগ। ফলে পড়ুয়ার সংখ্যাও দিন দিন কমছে বলে দাবি স্কুল কর্তৃপক্ষের। স্থানীয় বাসিন্দা আবুল হোসেন গাজির অভিযোগ, তাঁর মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে। স্কুল কিংবা প্রাইভেট টিউশন থেকে বাড়ি ফেরার সময় সেই কিশোরীর গোটা শরীর বিএসএফ পরীক্ষা নিরীক্ষার সামনে পড়তে হয়। শুধু তাঁর মেয়েই নয়, লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে সবাইকে এক প্রকার পরীক্ষা করতে দিতে হয় বলে অভিযোগ করে তাঁর ক্ষোভ, ‘‘এত পরীক্ষার পরেও আমাদের কপালে ‘স্মাগলার’ তকমা জোটে। তাঁর দাবি, “হয়তো সীমান্তে পাচার হয়, তাই বলে সবাই তো আর পাচারকারী নয়!”
  • Link to this news (প্রতিদিন)