• রমজানদের কাঁধেই শেষযাত্রা বাবুলালের, অপূর্ব সম্প্রীতির সাক্ষী থাকল কালনা
    এই সময় | ২৪ জুন ২০২৫
  • সূর্যকান্ত কুমার, কালনা

    বেঁচে থাকতে আপনজন বলতে কেউ ছিলেন না। কিন্তু বাবুলাল মান্ডি জানতেনই না, কাছের মানুষের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে প্রয়োজন পড়ে না রক্তের সম্পর্ক অথবা আত্মীয়তার পরিমণ্ডল!

    রবিবার বাবুলালের শেষকৃত্যে যাঁরা সঙ্গী হিসেবে ছিলেন, তাঁদের নাম রমজান শেখ, শহর আলি শেখ, আজিজুল শেখ, সইফুদ্দিন শেখ। কালনার বাঘনাপাড়ার মোকামতলা গ্রাম এক অপূর্ব সম্প্রীতির সাক্ষী হয়ে থাকল।

    মোকামতলা গ্রাম এমনিতে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। সেই গ্রামে একমাত্র হিন্দু হিসেবে বাস ছিল বাবুলালের (৬৭)। নিজের লোক বলতে কিছুই ছিল না তাঁর। অবশ্য তাতে কখনও সমস্যায় পড়তে হয়নি।

    অকৃতদার বাবুলাল গত কয়েক মাস ধরে অসুস্থ ছিলেন, রবিবার তাঁর মৃত্যু হয়। তার পরেই শুরু হয় চর্চা, তাঁর শেষকৃত্য করবেন কে? কিন্তু বেঁচে থাকতে যে মানুষকে কাছের জন না–থাকার হতাশা গ্রাস করতে পারেনি, তিনি না–থাকলেই বা কী! গ্রামের বাকি সকলে তো পাশেই ছিলেন, আছেনও।

    বাবুলালের শেষকৃত্যের দায়িত্ব তুলে নিলেন প্রতিবেশী রমজান, আজিজুলরা। চাঁদা তুলে শেষকৃত্যের খরচের টাকা তুলে ফেলেন তাঁরা। তার পরে সটান কালনার শহরের শ্মশানে। সেখানেই সমস্ত কাজ শেষ করে রমজানরা গ্রামে ফেরেন সোমবার।

    প্রয়াত প্রতিবেশীকে নিয়ে বলতে গিয়ে রমজানের চোখ ছলছল। বলে উঠলেন, ‘শেষ এক মাস ধরেই তো অসুস্থ ছিলেন। সেই সময়ে আমরাই পালা করে ওঁর দেখভাল এবং খাবারের ব্যবস্থা করতাম। বিরাট কিছু যে করতে পারতাম, তা তো নয়। নিজেদের ক্ষমতার মধ্যে থেকেই মানুষটাকে একটু আরাম দিতে চেয়েছি।’

    যোগ করলেন, ‘শেষ কয়েকদিন তো ও কিছু মুখেই তুলতে পারেনি। কী যেন সব বলত, আমরা বুঝতেও পারতাম না। তাই পাশের গ্রাম থেকে একজনকে আনা হয়েছিল ওর কথা বোঝার জন্য।’

    রবিবার বাবুলালের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরেই রমজানরা পাশের গ্রাম থেকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে ডেকে আনেন। তাঁদের পরামর্শ মেনেই বাবুলালের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। আজিজুল বলছিলেন, ‘ওঁরা যে ভাবে আমাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, সে ভাবেই শ্মশানে শেষকৃত্য হয়েছে।’ প্রিয় প্রতিবেশীর শেষযাত্রায় ছিলেন গ্রামের ৫২ জন, তার মধ্যে ৪৫ জনই সংখ্যালঘু।

    এত দিনের প্রতিবেশী চলে গেলেন। কী মনে হচ্ছে? গ্রামের বাসিন্দা ওয়াহাব আলি শেখ বলে উঠলেন, ‘মনটা খুব ফাঁকা হয়ে গেল। বাবুলালকে তো আমরা বরাবর নিজেদের পরিবারের সদস্য হিসেবেই দেখেছি। সে ভাবেই ওর সঙ্গে আমাদের ওঠাবসা ছিল। ধর্ম আমাদের সম্পর্কে কোনও বেড়া তুলতে পারেনি।’

    পাশে বসা রমজানের মন্তব্য, ‘মানুষের থেকে বড় আর কিছু হতেই পারে না। তার বিপদে পাশে থাকাই সবচেয়ে বড় ধর্ম। বাবুলালের সঙ্গে আর দেখা হবে না...’, কথাটা শেষ হলো না!

  • Link to this news (এই সময়)