যা হওয়ার তা-ই হল! তৃণমূল, বিজেপির ‘হিসাব’ মিলল! শুধু ‘শত্রু’ বাছতে অক্ষম কংগ্রেস এবং সিপিএম একই তিমিরে
আনন্দবাজার | ২৪ জুন ২০২৫
জয়ের আশা দূরদূরান্তেও ছিল না। লক্ষ্য ছিল রাজ্যের ‘দ্বিমেরু’ রাজনীতির প্রবণতায় কিছুটা ধাক্কা দিয়ে নিজেদের ভোট বাড়ানো। আর সেই পরিসংখ্যানকে হাতিয়ার করে রাজ্য জুড়ে বাম-কংগ্রেসের ‘পুনরুত্থান’ তত্ত্বের প্রচার শুরু করা। তাই তৃণমূলের ‘অভ্যন্তরীণ কোন্দলে’র কাহিনি শোনানো হচ্ছিল ফিসফিস করে। বিজেপি-কে ‘সেটিং করা বিরোধী’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল প্রতিটি প্রচার কর্মসূচিতে। কিন্তু রণকৌশল সফল হল না। কালীগঞ্জের উপনির্বাচনে জামানত বাঁচাতে পারল না বাম-কংগ্রেস জোট। ‘প্রধান শত্রু’ চিহ্নিতকরণে দ্বিধাই কি বঙ্গে বার বার ডোবাচ্ছে কংগ্রেস আর বামফ্রন্টকে? কালীগঞ্জের ফলাফল আবার সেই প্রশ্ন তুলে দিল।
কালীগঞ্জে কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে সিপিএমকে মাঠে নামানোর তথা দলের তরফ থেকে ভোট ব্যবস্থাপনা দেখভালের দায়িত্ব ছিল সুমিত দে-র উপর। ভোটের প্রচার শেষ হওয়ার পর নদিয়া জেলা সিপিএমের প্রাক্তন সম্পাদক সুমিত আনন্দবাজার ডট কমকে বলেছিলেন, ‘‘তৃণমূল এবং বিজেপির যে দ্বিমেরু রাজনীতি তৈরি করা হয়েছে, সেটা ভেঙে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা এই ভোটে রয়েছে। তৃণমূল বা বিজেপির বাইরে কোনও বিকল্প নেই, এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা এই ভোটে ধাক্কা খেতে পারে। সেটা আমরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে টের পেয়েছি।’’ তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাদের এই ধারণা ঠিক হলে সেটাই হবে এই উপনির্বাচনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’’ ভোটের ফলাফল বলছে, সেই ‘প্রাপ্তি’র স্বাদ বাম-কংগ্রেস পেল না। ‘দ্বিমেরু’ রাজনীতি ভেঙে উল্লেখযোগ্য ‘তৃতীয় মেরু’ বা ‘বিকল্প শক্তি’ হিসেবে মাথা তোলা তো দূরের কথা, গত বছর হওয়া লোকসভা নির্বাচনের প্রাপ্তিটুকুও ধরে রাখতে পারল না রাজ্যের দুই প্রাক্তন শাসকদল।
বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী কাবিলউদ্দিন ভোটগণনা কেন্দ্র থেকে বাইরে বেরিয়েই ‘সাফল্যে’র পরিসংখ্যান তুলে ধরার চেষ্টা করছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘‘গত বিধানসভা নির্বাচনের আমরা যা পেয়েছিলাম, এ বার তার থেকে তিন হাজার ভোট বেড়েছে।’’ তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, তৃণমূল এবং বিজেপি ‘সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ’ ঘটিয়েছে। তবু তাঁর ভোট বেড়েছে, কারণ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’দের ভোট তাঁর পক্ষে পড়েছে। কিন্তু কাবিলউদ্দিন যে পরিসংখ্যান সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন, তা হল, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কালীগঞ্জে জোটের প্রার্থী যে ভোট পেয়েছিলেন, তার চেয়ে এ বারের ভোটপ্রাপ্তি অনেকটাই কম।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কালীগঞ্জে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী পেয়েছিলেন প্রায় ১২ শতাংশ ভোট। জামানত বাঁচেনি। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগর লোকসভা আসনের কংগ্রেস সমর্থিত সিপিএম প্রার্থী এসএম সাদি কালীগঞ্জে পেয়েছিলেন ১৮.৩৮ শতাংশ ভোট। গোটা কৃষ্ণনগর লোকসভায় তিনি পেয়েছিলেন প্রদত্ত ভোটের ১২.৬৪ শতাংশ। সেখানেও জামানত বাঁচেনি। কিন্তু কালীগঞ্জ বিধানসভা এলাকায় ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে সে হার ছিল ১৮.৩৮ শতাংশ। এ বারের উপনির্বাচনে ওই ভোটটুকু ধরে রাখতে পারলেই জোটের জামানত বেঁচে যেত। কিন্তু বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী সেটুকুও পেলেন না। ১৫.২১ শতাংশে আটকে গেলেন কাবিলউদ্দিন।
জয়ী তৃণমূলের আলিফা আহমেদ পেয়েছেন ১,০২,৭৫৯ ভোট। প্রদত্ত ভোটের ৫৫.১৫ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থান পাওয়া বিজেপির আশিস ঘোষ পেলেন ৫২,৭১০ ভোট। প্রদত্ত ভোটের ২৮.২৯ শতাংশ। ২০২১ সালের বিধানসভা এবং ২০২৪ সালের লোকসভা, দুই নির্বাচনের চেয়েই এ বারে তৃণমূলের ভোটপ্রাপ্তির হার বেশি এবং বিজেপির ভোটপ্রাপ্তির হার কম। তবে শাসক এবং প্রধান বিরোধীর এই বাড়া-কমা গত বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে ২-৩ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই উপনির্বাচনে সাধারণত যেমন প্রবণতা এ রাজ্যে সাধারণত দেখা যায়, কালীগঞ্জে তার কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। শাসকের ভোট কিছুটা বেড়েছে। বিরোধীর ভোট কিছুটা কমেছে। দু’পক্ষেরই মূল ভোটব্যাঙ্ক অটুট। কিন্তু সাগরদিঘির উপনির্বাচনে জিতে কংগ্রেস-বাম জোট যে চমক দিয়েছিল, তেমন কিছু কালীগঞ্জে দেখা গেল না।
সাগরদিঘির উপনির্বাচন হয়েছিল গত লোকসভা ভোটের আগে। আর ২০২৪ সালে হয়ে যাওয়া শেষ লোকসভা ভোটের পর যে ১১টি বিধানসভা উপনির্বাচন হল রাজ্যে, তার সব ক'টিতেই জিতল তৃণমূল। তার মধ্যে চারটি আসন ছিল বিজেপির জেতা (রায়গঞ্জ, রানাঘাট দক্ষিণ, বাগদা, মাদারিহাট)। বাকি সাতটিতে (মানিকতলা, সিতাই, নৈহাটি, হারোয়া, মেদিনীপুর, তালড্যাংড়া এবং কালীগঞ্জ) ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল শাসকদলই।
বাম-কংগ্রেসের কেন এই হাল? কংগ্রেস প্রার্থী গণনা কেন্দ্র থেকে বেরিয়েই দাবি করেছিলেন, ‘মেরুকরণ’ এর প্রধান কারণ। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘শুভেন্দু অধিকারী আর সুকান্ত মজুমদার পরিকল্পনা করেই বার বার কালীগঞ্জে প্রচারে আসছিলেন। হিন্দুপ্রধান এলাকায় গিয়ে তাঁরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে উগ্র প্রচার চালাচ্ছিলেন। আর হিন্দুদের একজোট হতে বলছিলেন। সেটাই হয়েছে। মুসলিম ভোট তৃণমূলের দিকে চলে গিয়েছে। আর হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলোয় একচেটিয়া ভোট বিজেপির দিকে গিয়েছে।’’ তা হলে কংগ্রেস প্রার্থী গত বিধানসভা নির্বাচনের চেয়ে এ বার হাজার তিনেক ভোট বেশি পেলেন কী ভাবে? কংগ্রেস প্রার্থীর ব্যাখ্যা, ‘‘কিছু ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের ভোট আমাদের দিকে নতুন করে এসেছে।’’
বিজেপি এই ভোটে জয়ের আশা করেনি। ত্রিমুখী সমীকরণ বুঝে নেওয়ার দরকার ছিল ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে। ফলাফলে তারা ‘খুশি’। এবং বিজেপি নেতৃত্বের বয়ানও কংগ্রেসের সঙ্গে মিলছে। নির্বাচনের আগেও তাঁরা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন যে, কালীগঞ্জে হিন্দু ভোটের আরও বেশি একত্রীকরণ তাঁদের লক্ষ্য। সোমবার গণনা শেষ হওয়ার আগেই শুভেন্দু দাবি করেন যে, হিন্দু-প্রধান এলাকাগুলিতে বিজেপির পক্ষে ভোটের হার আগের চেয়েও বেশি। আর গণনা শেষ হতেই বিজেপির আইটি সেল দ্রুত ‘পরিসংখ্যান’ প্রকাশ করা শুরু করে। কালীগঞ্জে প্রদত্ত হিন্দু ভোটের ৭৪ শতাংশেরও বেশি বিজেপি পেয়েছে বলে দাবি করা শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুভোটের একত্রীকরণের এই হার ‘ইতিহাসে সর্বোচ্চ’ বলেও বিজেপি নেতাকর্মীরা সমাজমাধ্যমে পোস্ট করতে শুরু করেন।
বঙ্গে বাম-কংগ্রেসের এই লাগাতার ব্যর্থতার কারণ শুধুমাত্র ‘মেরুকরণ’ নয় বলে অবশ্য অনেকেই মনে করছেন। তাঁদের মতে, সিপিএম এবং কংগ্রেস এ রাজ্যে স্পষ্ট ভাবে ‘শত্রু’ চিহ্নিত করতে পারছে না। তৃণমূলকে ‘প্রধান শত্রু’ ঘোষণা করা হবে, নাকি বিজেপিকে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। ফলে কংগ্রেস-সিপিএমের রাজনীতি বাংলায় দিশাহীন হয়ে পড়েছে। তারই ফল ফলছে একের পর এক নির্বাচনে।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, বাম-কংগ্রেসকে যদি নির্বাচনী সাফল্য পেতে হয়, তা হলে গোপনে হলেও বিজেপির সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হবে। কারণ বিজেপিকে ‘প্রধান শত্রু’ চিহ্নিত করে তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়ে কংগ্রেস-সিপিএমের এই রাজ্যে কোনও লাভ নেই। তাতে হারানো জনভিত্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হবে। বিজেপির ‘মেরুকরণ’ প্রয়াস আরও শক্তিশালী হবে। কিন্তু তৃণমূলকে ‘প্রধান শত্রু’ চিহ্নিত করে বাম-কংগ্রেস যদি ময়দানে নামে, তা হলে বরং বিজেপির বর্তমান সমর্থকদের অপেক্ষাকৃত কম কট্টর অংশ বাম-কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকতে পারে।
বাম-কংগ্রেস নেতৃত্বও সে কথা বোঝেন। কিন্তু সর্বভারতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া তাঁদের এই ‘দ্বিধান্বিত’ অবস্থানের দিকে ঠেলছে বলে অনেকের মত। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কংগ্রেস এবং বামেদের ‘প্রধান শত্রু’ বিজেপি। সেখানে তৃণমূলও বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে একই বন্ধনীতে। পশ্চিমবঙ্গে এসে সেই সমীকরণ ভুলে যাওয়া দরকার বলে অনেকের মত। কিন্তু কংগ্রেস-সিপিএম তা করতে পারছে না। বঙ্গ রাজনীতির প্রেক্ষাপট যে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে প্রায় কখনওই মেলে না, সে সত্যের দিকে চোখ ঠেরে থাকতে গিয়ে বিপদ বাড়ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রাক্তন কংগ্রেস তথা অধুনা তৃণমূল নেতা টেনিস দুনিয়ার উদাহরণ টানছেন। তাঁর কথায়, ‘‘খেলাটা বাস্তবসম্মত ভাবে খেলতে হবে তো। এক পাশে আলকারাজ় খেলছেন, অন্য পাশে সিনার। আমি হঠাৎ উঠে এসে যদি বলি, আমাকে সমর্থন করুন, আমি ওদের দু’জনকেই হারিয়ে দেব, কেউ মানবে? কংগ্রেস-সিপিএম সেই বাস্তবটাকেই স্বীকার করতে চাইছে না।’’