সরকারি তালিকায় স্কুলের গ্রন্থাগারে মুখ্যমন্ত্রীর বই, বিতর্ক
আনন্দবাজার | ২৪ জুন ২০২৫
রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন স্কুলগুলিতে গ্রন্থাগারের জন্য কী কী বই কিনতে হবে, এ বার তার তালিকা তৈরি করে দিল শিক্ষা দফতর। সেই তালিকায় দেশ-বিদেশের একাধিক নামী ও অনামী লেখকের সঙ্গে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেকগুলি বইও।
সরকার-পোষিত এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ২০২৬টি স্কুলকে গ্রন্থাগারের বই কেনার জন্য এক লক্ষ টাকা করে দিচ্ছে শিক্ষা দফতর। যা যা বই কিনতে হবে, সেগুলির পাঁচটি সেট তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি সেটে রয়েছে পাঁচশোর কিছু বেশি বই। নির্বাচিত প্রতিটি স্কুল একটি করে বইয়ের সেট পাবে। প্রতিটি সেটের সমস্ত বইয়ের নাম, লেখকের নাম, প্রকাশনার নাম, সেটি কী ধরনের বই, বইয়ের আইএসবিএন নম্বর এবং দাম তালিকায় লেখা আছে। প্রতিটি সেটেই রয়েছে আলাদা আলাদা বই। প্রকাশকদের থেকে সেই বইগুলি নিয়ে জেলা স্কুল পরিদর্শকের মাধ্যমে স্কুল কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজে মধ্যস্থতা করবে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড। এই গোটা প্রক্রিয়ায় অবশ্য স্কুল কর্তৃপক্ষ বই পছন্দ করে কিনতে পারবেন না।
স্কুল কর্তৃপক্ষ বই না কিনলে সেগুলি স্কুলের হাতে পৌঁছবে কী ভাবে? গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যে বইগুলি দিয়ে পাঁচটি সেট তৈরি হয়েছে, সেই সমস্ত বই নির্বাচন করেছে শিক্ষা দফতর নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি। সেই বইগুলি প্রকাশকদের কাছ থেকে নিয়ে সেট তৈরি করে জেলা স্কুল পরিদর্শকের অফিসে পৌঁছে দেব আমরা। বইয়ের সেট এবং বইয়ের রসিদ স্কুল কর্তৃপক্ষ নেবেন এবং প্রকাশকদের নামে চেক তৈরি করে দেবেন। সেই চেক আমরা বইয়ের প্রকাশকদের হাতে পৌঁছে দেব। আমাদের কাজটা আসলে পিয়নের মতো। আমাদের কাজ প্রকাশক ও স্কুলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।’’ একটি জেলার স্কুল পরিদর্শক বললেন, ‘‘বই কেনার জন্য টাকা কিন্তু সরাসরি স্কুলই পাচ্ছে। যে বইগুলি স্কুল কিনছে, সেগুলির একটি রসিদ আমরা সংগ্রহ করব। সেই রসিদ আমরা শিক্ষা দফতরে পাঠিয়ে দেব।’’
শিক্ষকদের অভিযোগ, এই গোটা প্রক্রিয়ায় স্কুল কর্তৃপক্ষের পছন্দ করে বই কেনার সুযোগ নেই। প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক তথা শিক্ষক নেতা নবকুমার কর্মকার বলেন, ‘‘আগে স্কুল শিক্ষা দফতরের দেওয়া টাকায় ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের পছন্দ মতো বই কেনা হত স্কুলের গ্রন্থাগারের জন্য। স্কুল কী বই কিনবে আর কী বই কিনবে না, সেই বিষয়ে তাদের স্বাধীনতা থাকত। এখন আর স্কুলগুলির সেই স্বাধীনতাথাকল না।’’
যে পাঁচ সেট বই দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে প্রথম ও চতুর্থ সেটে কী কী বই রয়েছে, তা দেখার সুযোগ মিলেছে। এক নম্বর সেটে দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে শিশু ও কিশোরদের জন্য লিখেছেন, দেশ-বিদেশের এমন বহু নামী সাহিত্যিকের বই রয়েছে। আবার ওই সেটেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই রয়েছে ১৯টি। যার মধ্যে রয়েছে ‘কোভিডের দিনলিপি’, ‘দুয়ারে সরকার’, ‘দুয়ারে সরকার আপনার আমার’, ‘কবিতা বিতান’, ‘মানুষের পক্ষে উন্নয়নের লক্ষে’, ‘সবুজ বাংলা’, ‘জাগরণের বাংলা’-সহ ১৯টি বই। চার নম্বর সেটেও দেখা যাচ্ছে, দেশি-বিদেশি নামী লেখকদের বইয়ের তুলনায় মুখ্যমন্ত্রীর বইয়ের সংখ্যা বেশি। সেই সেটেও মুখ্যমন্ত্রীর লেখা ‘মানবিক’, ‘উপলব্ধি’, ‘কথাঞ্জলি’-সহ ১৯টি বই রয়েছে। এই দু’টি সেটে স্বল্প নামী অনেক লেখকের বইও রয়েছে।
‘মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি’র নেতা অনিমেষ হালদারের প্রশ্ন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর যে ১৯টি বই রয়েছে, তার মধ্যে ‘সবুজের বাংলা’, ‘জাগরণের বাংলা’, ‘দুয়ারে সরকার’— এই বইগুলো কি শিশু-কিশোরদের পাঠ্য? স্কুলের গ্রন্থাগারের জন্য এই বইগুলি কারা নির্বাচন করেছেন? স্কুলের বই নির্বাচন করতে গিয়ে সরকারকে খুশি করার দায়ই বেশি ছিল বলেমনে হচ্ছে।’’
বই কেনার স্বাধীনতা কেন স্কুল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হচ্ছে না? শিক্ষা দফতরের এক আধিকারিকের মতে, ‘‘এখন বই খুব সহজেইস্কুলের গ্রন্থাগারে পৌঁছে যাবে। আগে যখন বই সরাসরি স্কুল কিনত, তখন দেখা যেত, অনেক স্কুল শিক্ষাদফতরের পাঠানো টাকায় বই কেনেনি। যে টাকা শিক্ষা দফতর পাঠাত, বই কেনার জন্য তা খরচ করত না অনেক স্কুল। এখন এই পদ্ধতিতে স্কুলের গ্রন্থাগারের জন্য বই কেনা সুনিশ্চিত করা গিয়েছে।’’