তারা এক ক্লাসে একই শিক্ষকের কাছে পড়ে। কিন্তু মিডডে মিল রাঁধার হাঁড়ি আলাদা! পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলীর কিশোরীগঞ্জ মনমোহনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাঁধুনি, বাসন থেকে খাওয়ার জায়গা— হিন্দু ও সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের জন্য আলাদা। জেলা স্কুল পরিদর্শক (প্রাথমিক) প্রলয়েন্দু ভৌমিক বলেন, ‘‘ঘটনাটি নজরে এসেছে। কেন এমন ঘটেছে, খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।’’ স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথও বলেন, ‘‘এমন ঘটনা জানা ছিল না। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’’
ভাগীরথীর পাড়ে নসরৎপুর পঞ্চায়েতের এই স্কুলে স্থানীয় মোহনপুর, কিশোরীগঞ্জ ছাড়াও, নদিয়ার ফকিরডাঙা থেকে কিছু ছেলেমেয়ে পড়তে আসে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ৭২। রয়েছেন চার শিক্ষক। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, আশপাশের গ্রামগুলিতে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে বাস। কখনও কোনও অশান্তির ঘটনা ঘটেনি। তা হলে স্কুলের খাবারে ভেদাভেদ কেন, সে প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি কেউ। স্কুলটির প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক গোবিন্দ ভদ্র বলেন, ‘‘২০০৫ সালে যখন ওখানে দায়িত্ব নিই, তার আগে থেকেই ওই রীতি চালু ছিল। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে মিডডে মিল এক করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।’’
রান্নার দায়িত্বে যে দু’জন রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সোনালি মজুমদার বলেন, ‘‘আমি জনা চল্লিশের রান্না করি। বাসন আলাদা, খাওয়ার জায়গা আলাদা। তবে গ্যাস সিলিন্ডার একটাই।’’ আর এক কর্মী জ্ঞান বিবির কথায়, ‘‘প্রতিদিন মুসলমান পড়ুয়াদের মাথা গুণে তাদের জন্য রাঁধি।’’ পড়ুয়াদের অনেকে জানায়, তারা এক সঙ্গে স্কুলে আসে, পড়াশোনা ও খেলাধুলো এক সঙ্গে করে। কিন্তু খাওয়ার সময়ে আলাদা বসার নিয়ম রয়েছে। তা তাদের ভাল লাগে না।
সরকারি স্কুলে এমন কেন হবে? স্কুলে এমন চলছে, তা তাদের অজানা ছিল বলে দাবি পঞ্চায়েতের। উপপ্রধান মোবিল হোসেন মণ্ডলের বক্তব্য, ‘‘বিষয়টি জানার পরেই, স্কুল পরিদর্শকের নজরে আনা হয়েছে। সব পড়ুয়ার মিডডে মিল এক সঙ্গে রান্না ও খাওয়ার ব্যবস্থার চেষ্টা করছে পঞ্চায়েত।’’ পূর্বস্থলী ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ মল্লিক বলেন, ‘‘স্কুল থেকে শিশুরা বিভেদের শিক্ষা পাচ্ছে, তা দুর্ভাগ্যের।’’ মঙ্গলবার ওই স্কুল পরিদর্শনে যান পূর্বস্থলী দক্ষিণ চক্রের স্কুল পরিদর্শক সৌমেন মাহাতো। যদিও তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা যায়নি। জবাব মেলেনি মোবাইল-বার্তার।
স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক তাপস ঘোষ জানান, তিনি বছরখানেক দায়িত্বে এসেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এমন ব্যবস্থা চলা উচিত নয়। অভিভাবকদের সঙ্গে এর আগে এ নিয়ে কথা বলেছি, তবে কাজ হয়নি। আলাদা রান্নায় খরচও বেশি হয়। ফের অভিভাবকদের ডেকে বৈঠক করব।’’
অধিকাংশ অভিভাবক গোটা বিষয়টি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক জনের দাবি, এটাই ‘প্রচলিত’। তাই তাঁরা আপত্তি করেন না। শিশু মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়ের মত, ‘‘শৈশব থেকে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের বীজ বোনা হয়ে যাচ্ছে ওই শিশুদের মধ্যে। এর প্রভাব ভাল হতে পারে না।’’