রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতির জন্য আবার কেন্দ্রীয় সরকার এবং ডিভিসিকে দায়ী করলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই সঙ্গে আবার রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতিকে মনুষ্যকৃত বা ‘ম্যান মেড’ বলেও দাবি করেন তিনি। মঙ্গলবার বিধানসভায় পরিবেশরক্ষার শপথ নেন মমতা।
গত কয়েক দিনে টানা বর্ষণে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়। মূলত, দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলা ভেসে গিয়েছে। দ্বারকেশ্বর, গন্ধেশ্বরী, শিলাবতী, কংসাবতী— সব নদীই ফুঁসছে টানা বৃষ্টিতে। যার জেরে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় রাজ্যের তিন জেলা— বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামে। প্রভাব পড়েছে উত্তরবঙ্গেও। ঘাটাল ও গড়বেতার অবস্থা সঙ্গিন হয়ে উঠেছে। কেন রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতির ছবি এখনও বদল করা গেল না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। বিরোধীদের নিশানায় ছিল শাসকদল তৃণমূল। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁর সরকার কী করছে, তা মঙ্গলবার বিধানসভায় বিশদে জানান মুখ্যমন্ত্রী।
বাংলার বন্যা পরিস্থিতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মনুষ্যকৃত বা ‘ম্যান মেড’ বলে দাবি করেন মমতা। তাঁর অভিযোগ, ‘‘ডিভিসি না-বলেই জল ছাড়ে। সেই কারণেই বন্যা হয়েছে। কথা না-বলে বিহার, ঝাড়খণ্ডও জল ছেড়ে দেয়। সেই জলে প্লাবিত হয় বাংলা।’’ মাইথন, পাঞ্চেতের মতো বাঁধগুলি থেকেও অতিরিক্ত জল ছাড়া রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতির কারণ বলে জানালেন মুখ্যমন্ত্রী। উত্তরবঙ্গে প্লাবনের জন্য ভূটানের জল ছাড়ার দিকেও আঙুল তুললেন তিনি। অভিযোগ, ‘‘ইন্দো-ভূটান রিভার কমিটিতে বাংলার কোনও প্রতিনিধি নেই।’’ তাঁর মতে, সেই কারণেই ভূটানের জল ছাড়ায় বাংলার ক্ষতি হচ্ছে। মমতার দাবি, ওই কমিটিতে বাংলার প্রতিনিধির থাকা প্রয়োজন।
টানা বৃষ্টির জেরে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের। প্রশ্ন উঠছে, ঘাটাল ‘মাস্টার প্ল্যান’-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে! ২০১৪, ২০১৯ এবং ২০২৪— গত তিনটি লোকসভা ভোটেই ঘাটালে রাজ্যের শাসকদলের তুরুপের তাস ছিল ‘মাস্টার প্ল্যান।’ ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের মুখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ঘোষণা করেছিলেন, ওই প্রকল্প রাজ্য সরকার একাই কার্যকর করবে। সেইমতো চলতি বছরের রাজ্য বাজেটে মাস্টার প্ল্যানের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু বন্যা পরিস্থিতির কারণে সেই কাজও থমকে রয়েছে। মঙ্গলবার ফের ঘাটাল ‘মাস্টার প্ল্যান’ নিয়ে কেন্দ্রকে দুষলেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘ঘাটাল নিয়ে কিছুই করেনি কেন্দ্র।’’ আগামী দু’বছরের মধ্যে ঘাটাল ‘মাস্টার প্ল্যান’ শেষ হয়ে যাবে বলেও জানান তিনি। পাশাপাশি মমতার অভিযোগ, বাংলায় থাকা দুই বন্দরে কোনও ড্রেজিং হয় না। সময়মতো ড্রেজিং করলে বন্যা আটকানো সম্ভব।
বন্যা মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের পুকুর কাটার সিদ্ধান্তের কথা জানান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘২০১১ সালে অমিত মিত্র দেড় লক্ষ পুকুর কাটার কথা বলেছিলেন। তাঁর পরামর্শের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা ইতিমধ্যেই ‘জল ধরো, জল ভরো প্রকল্প’-এর অধীনে সাড়ে চার লক্ষ পুকুর কেটেছি।’’ মমতার মতে, বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য পুকুরেরই প্রয়োজন। যত বেশি পুকুর থাকবে, তত বন্যা কম হবে। এ ছাড়াও, পুকুর জীবিকার অন্যতম বিকল্প বলে মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী। একই সঙ্গে কেউ যদি পুকুর বোজানোর চেষ্টা করেন, তবে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করা হবে। মমতার দাবি, ‘‘পুরসভাগুলি পুকুর বুজিয়ে বাড়ি তৈরি করে দেয়। এর ফলে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এই ব্যাপারে পুর দফতর কাজ করেছে। পরিবেশ দফতরকে বলব, কড়া পদক্ষেপ করতে।’’
৩০-৪০ কিমি বেগে ঝোড়ো হাওয়া, সঙ্গে ভারী বর্ষণ, আগামী পাঁচ দিন কোন কোন জেলায় ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা?
পরিবেশ দূষণ নিয়েও সরব হন মমতা। তিনি জানান, পরিবেশ দূষণরোধে কী কী করণীয়, তা নিয়ে কেন্দ্র নির্দেশ দিতে পারে। কিন্তু রাজ্য সরকার ‘রুল ফ্রেম’ করবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় এটাই নিয়ম। কিন্তু মমতার অভিযোগ, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সেই সব নিয়ম মানে না। তাঁর কথায়, ‘‘আইন করে দূষণরোধের কথা বলব আমি।’’
মমতার বক্তৃতায় উঠে এসেছে বিশ্বব্যাপী অশান্তির প্রসঙ্গও। তিনি বলেন, ‘‘যুদ্ধ যুদ্ধ করে সমুদ্রে আগুন জ্বলছে। আমি ছোট্ট জায়গায় কাজ করি। এ বিষয়ে ভারত সরকার যা বলার বলবে। যুদ্ধে পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে।’’ কূটনৈতিক ভাবে শান্তি ফেরানো সম্ভব বলে মনে করেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মমতা রাজীব গান্ধীর জমানার কথাও বলেন। তাঁর কথায়, ‘‘রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন আমাকে আর আনন্দ শর্মাকে অ্যাঙ্গোলায় পাঠানো হয়েছিল। গিয়েছিলাম। সেখানে কী করেছিলাম, তা এখানে বলব না।’’
বিধানসভায় বিধায়কদের উপস্থিতির উপর পুরস্কার দেওয়ার কথাও বলেন মমতা। সেই দায়িত্ব দিয়েছেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঁধে। সেই সঙ্গে সোমবার বিধানসভার অধিবেশনকক্ষে বিজেপির বিক্ষোভ নিয়ে নিন্দা করেন মমতা। নাম না করে তিনি বলেন, ‘‘অনেকের বিরুদ্ধেই বিধানসভার কর্মীদের উপর হামলা করার অভিযোগ রয়েছে। মার্শালের গায়ে হাত পড়েছে। আর যাঁরা মারলেন, তাঁরাই থানায় অভিযোগ জানালেন!’’ এই বিষয়েও স্পিকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব দেন মুখ্যমন্ত্রী।