মুখ্যমন্ত্রীর যুদ্ধ-বিরোধী বার্তা, সভায় উপেক্ষিত বালিকা খুন, বিক্ষোভ পথে
আনন্দবাজার | ২৫ জুন ২০২৫
ইজ়রায়েল, প্যলেস্টাইন, ইরান এল। তাদের যুদ্ধ বন্ধে করণীয় নিয়েও কথা হল। কিন্তু মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগে নির্বাচন-উত্তর হিংসায় মৃত কালীগঞ্জের বালিকা তামান্না খাতুনের জায়গা হল না রাজ্য বিধানসভার আলোচনায়। নিজের নিজের রাজনৈতিক সীমার মধ্যেই পরিষদীয় দায়িত্ব পালন করল সরকার এবং বিরোধী পক্ষ। তবে বাইরে দিনভর কংগ্রেস ও বামেদের বিক্ষোভ চলল রাজ্য জুড়ে।
কে হিন্দু-প্রেমী আর কে সংখ্যালঘু-দরদী, এ বারের বিধানসভা অধিবেশন বারবার তা নিয়ে উত্তপ্ত হয়েছে। পারস্পরিক সেই বিবাদে হাতাহাতি হয়েছে, জের গড়়িয়েছে থানা পর্যন্ত। বিরোধীদের তুলসী-চারা নিয়ে বিক্ষোভ আর সরকার পক্ষের মন্ত্রী- বিধায়কদের বিরোধীদের বাধা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটলেও রাজ্যের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া কালীগঞ্জের খুন নিয়ে টুঁ শব্দটি করলেন না তাঁদের কেউই!
অধিবেশনের শেষ দিনে, মঙ্গলবার গোড়া থেকেই অধিবেশন বয়কট করে নিজেদের পরিষদীয় অধিকারের দাবিতে বিক্ষোভে ছিলেন বিজেপির বিধায়কেরা। বিরোধী-শূন্য কক্ষে অধিবেশন শুরু হলে আচমকাই সভাপক্ষে হাজির হন মুখ্যমন্ত্রী। একাধিক জেলার বন্যা-পরিস্থিতি, পরিবেশ, দূষণ এবং সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে বক্তৃতা করেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘কূনৈতিক ভাবে শান্তির পথে (ভারতের) এমন উদ্যোগী হওয়া উচিত, যাতে যুদ্ধ থামে।’’ এই ক্ষেত্রে ইজ়রায়েল, প্যালেস্টাইন বা ইরানের নাম উল্লেখ করেননি তিনি। বরং তিনি বলেন, ‘‘বিদেশ মন্ত্রক পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। আমার কিছু বলা ঠিক কি না, বলতে পারি না। তবু বলছি, যুদ্ধে পরিবেশ নষ্ট হয়।’’ তবে এ প্রসঙ্গে প্যালেস্টাইন সম্পর্কে ভারতের পুরনো অবস্থানের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
কালীগঞ্জে উপনির্বাচনে জয়োল্লাসের বোমায় নিহত বালিকাকে নিয়ে সরকার পক্ষের নীরবতার প্রশ্নে তৃণমূলের পরিষদীয় এক নেতার মন্তব্য, ‘‘ঘটনার পরেই মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনকে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। আর কী বলার থাকতে পারে!’’ বিজেপির পরিষদীয় দল এ দিনের ধর্নার আগে বালিকার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে নীরবতা পালন করেছে। বিজেপির সচেতক শঙ্কর ঘোষ বলেন, ‘‘বিজেপি বিধায়কেরা অধিবেশনে থাকবেন না, বিরোধী দলনেতা আসবেন না জেনে মুখ্যমন্ত্রী চোরের মতো লুকিয়ে বিধানসভায় এসেছেন। কারণ, তাঁর মনে অপরাধ রয়েছে। ক্ষমতার লিপ্সা মুর্শিদাবাদের বাবা-ছেলে কিংবা এই শিশুটির মৃত্যুতেও তাঁকে উদাসীন করে রেখেছে।’’ কালীগঞ্জে বিজেপির প্রার্থী আশিস ঘোষ অবশ্য মোলান্দি গ্রামে তামান্নার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও বলেছেন, ‘‘তৃণমূল কর্মীরা এক একটা গুন্ডা, হার্মাদ! জেহাদিরা বোমা মেরেছে। যাদের পরিবারের মেয়েটি মারা গিয়েছে, তারা আমাদের সমর্থক নয়, তবুও আমাদের প্রতিনিধি সেখানে গিয়েছিল। একটা বাচ্চা মেয়ের প্রাণ চলে যাবে, এটা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মুখ্যমন্ত্রী এখন বড় বড় কথা বলছেন, অন্য কোনও মুখ্যমন্ত্রী হলে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারতেন না!’’
শাসক দলের জয়ের উল্লাস চলাকালীন বোমার আঘাতে বালিকার মৃত্যুর প্রতিবাদে কলকাতা-সহ সারা রাজ্যে এ দিন ও আজ, বুধবার সারা রাজ্যে প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে সিপিএম। কলকাতায় যাদবপুর, কলেজ স্ট্রিট-সহ নানা জেলায় স্থানীয় ভাবে বিক্ষোভে নেমেছিলেন সিপিএম কর্মী-সমর্থকেরা। সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠকের প্রথম দিনে ওই ঘটনা আলোচনায় এসেছে, কালীগঞ্জে প্রতিবাদ-সভার পরিকল্পনাও হয়েছে।
তবে গোটা রাজ্যে প্রতিবাদে চোখে পড়ার মতো সক্রিয় ছিল কংগ্রেস। উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্য কলকাতা জেলা কংগ্রেসের ডাকে যথাক্রমে হাতিবাগান, টালিগঞ্জ ফাঁড়ি এবং রাজাবাজারে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন দলের নেতা-কর্মীরা। উল্টোডাঙায় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের দফতরের সামনে পুতুল হাতে বসে বিক্ষোভ দেখিয়েছে যুব কংগ্রেস। পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ হয়েছে গার্ডেনরিচেও। দলের নেতা-কর্মীরা প্ল্যাকার্ড হাতে বলেছেন, ‘উল্লাসে শিশুর মৃত্যু, এ কেমন বাংলা’। প্রতিটি জায়গা থেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতার আমলে বাংলায় ‘নৈরাজ্য’-কে নিশানা করে ওই ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবি করা হয়েছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার ও দলের অন্য নেতারা গিয়েছিলেন নিহত বালিকার গ্রামে।