প্রশান্ত পাল ও শিলাদিত্য সাহা
শোয়ার ঘরে দরজা ছিল। গোয়ালঘরে পর্দাও। তবু ভোরবেলা চুপচাপ ঢুকে পড়ল বাঘ! পশ্চিমবঙ্গ–ঝাড়খণ্ড সীমানায় পুরুলিয়ার ঝালদা ঘেঁষা পড়শি রাজ্যের মাড়দু গ্রামে বুধবার আপাত নিস্তরঙ্গ সকালটা শুরু হলো এতটাই নাটকীয় ভাবে।
গ্রামের বাসিন্দা পুরন্দর মাহাতোর একতলা বাড়িতে খোলা দরজা দিয়ে একেবারে বেডরুমে ঢুকে পড়ে রীতিমতো কেঁদো চেহারার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। তখন ঘরের ভিতরেই ঘুমোচ্ছিল তিন শিশু। আশ্চর্যের বিষয়, তাদের কোনও ক্ষতি করেনি বাঘটি।
প্রায় ১২ ঘণ্টা পরে বন দপ্তরের পাতা খাঁচায় ধরা দেয় সেই ডোরাকাটা। রাঁচি জেলার সিল্লি থানা এলাকার এই মাড়দু গ্রামটি ঝালদার সুবর্ণরেখা নদীর থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে। ফলে বাঘ বেরনোর খবরে তৎপর হয়ে যান পুরুলিয়ার বনাধিকারিকরাও। তবে দিনের শেষে মানুষ থেকে বাঘ— সবাই অক্ষত থাকায় স্বস্তি ফেলেছে গ্রাম।
কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে মোবাইলে কৃষ্ণনাম শোনার অভ্যাস রয়েছে পুরন্দরের। বুধবারও ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ উঠে একতলা বাড়ির লোহার দরজা খুলে বাইরে দালানে বসে মোবাইলটা চালিয়েছিলেন। তার পরেই মেয়ে সোনিকাকে ঘুম থেকে তুলে পাশে গোয়ালঘরে থাকা গোরু–ছাগল–মুরগিগুলোকে উঠোনে ছেড়ে দিতে বলেন।
এটাই তাঁদের রোজের রুটিন। এ দিন ছাগল ছাড়তে যেতেই মেয়ে দেখে, সামনে দালানে বসে বাঘ! সে চিৎকার করে বাবার দিকে ছুটে যায়। পুরন্দরও মেয়েকে নিয়ে দৌড়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে যান।
কারখানার ঠিকা শ্রমিক পুরন্দরের কথায়, ‘আমরা ঘরে ঢোকার সময়ে লোহার দরজাটা বন্ধ করতে পারিনি। ভিতরে তখন আমার আরও দুই মেয়ে আর আমার এক আত্মীয়ের বছর এগারোর মেয়ে দুটো ঘরে চৌকি পেতে ঘুমোচ্ছিল।
ওদের সেখান থেকে সরিয়ে বের করার চেষ্টা করছিলাম। ততক্ষণে খোলা সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে চৌকির তলায় বসে পড়ে বাঘ। তার মধ্যেই একটা ঘরের পাল্লা টেনে বাচ্চাদের বের করে দিই।
নিজে কী ভাবে বেরোব বুঝতে পারছিলাম না। শেষে বাঘের পাশ দিয়েই কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে সদর দরজাটা সপাটে বন্ধ করে তালা মেরে দিই!’ ভোরের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বিকেলেও যেন ঘোরের মধ্যে পুরন্দর।
বাঘ বেরনোর খবর ভোরেই গিয়েছিল রাচির বন বিভাগে, সিল্লি বিটের মাহিলং রেঞ্জে। রাঁচির ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার শ্রীকান্ত ভার্মা বিকেলে ফোনে বলেন, ‘ভোর ৫টা নাগাদ ঘটনা ঘটে, আমরা খবর পাই ৬টা নাগাদ। সঙ্গে সঙ্গেই টিম সতর্ক হয়ে যায়।
রাঁচি ও পালামৌ থেকে বনাধিকারিকদের দল যায়। ট্র্যাঙ্কুলাইজ়ার নিয়েও টিম পাঠানো হয় মাড়দু গ্রামে। দুপুরের পরে কোনও টোপ ছাড়াই খালি খাঁচা বসানো হয় ঘরের দরজার সামনে। ততক্ষণ ঘরেই বন্দি ছিল বিশালাকার বাঘটি।
বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ সে ছুটে এসে ঢুকে পড়ে খাঁচায়। ফাঁদে পা দিয়েছে বুঝে প্রবল গর্জনও শুরু করেছিল। তখন ওকে ‘সিডেটিভ’ দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়।’ বন দপ্তর প্রথমে জানায়, গ্রাম থেকে উদ্ধার করে বাঘটিকে রাঁচির বিরসা চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাওয়া হবে।
পরে রাতে পালামৌ টাইগার রিজ়ার্ভের ফিল্ড ডিরেক্টর এসআর নাতেশ বলেন, ‘বাঘটিকে আমরা আজই পালামৌ নিয়ে যাচ্ছি। ওখানেই ওর শারীরিক পরীক্ষা আর ডিএনএ অ্যানালিসিস হবে।’
শ্রীকান্তর কথায়, ‘এটি বছর পাঁচেকের পুরুষ বাঘ। মনে করা হচ্ছে, গত কয়েক মাসে এই বাঘটিই পালামৌ থেকে দলমা পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া–বাঁকুড়া জেলায় ঘোরাফেরা করেছিল। এর আগে পালামৌ আর দলমায় একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ বাঘের ছবি উঠেছিল ক্যামেরা ট্র্যাপে।
এ দিনের ধরা পড়া বাঘের স্ট্রাইপ বা ডোরাকাটা দাগের সঙ্গে আগের সেই ‘ফোটো আইডি’ মিলিয়ে দেখা হবে। এর আগে এই অঞ্চলে ঘোরাফেরা করা একটি বাঘের লোমের ডিএনএ অ্যানালিসিস হয়েছিল দেরাদুনে, ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ায়। সেই ডিএনএ স্যাম্পলও মেলানো হবে।
সব মিলে গেলে নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে, এই বাঘটিই এর আগে পালামৌ হয়ে দলমা পেরিয়ে পড়শি রাজ্যে ঢুকেছিল।’ ঘটনা হলো, গত বছরের শেষে ওডিশার সিমলিপাল থেকে ঝাড়খণ্ড হয়ে বাংলায় ঢুকে মাসখানেক কাটিয়েছিল বাঘিনি জ়িনাত।
তাকে ধরে সিমলিপাল পাঠানোর আগেই ওই এলাকায় আরও একটি বাঘের খোঁজ পেয়েছিলেন বনকর্মীরা। তাই এ দিনের বাঘটিকে জ়িনাতের সেই ‘বয়ফ্রেন্ড’ বলেও দাবি করছেন কেউ কেউ।
ঝাড়খণ্ডের প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) পরিতোষ উপাধ্যায় জানিয়েছেন, বুধবারের গোটা রেসকিউ অপারেশনের ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো হয়েছে ন্যাশন্যাল টাইগার কনজ়ারভেশন অথরিটিকে।
পরিতোষের কথায়, ‘ওই গৃহস্থের সাহসের প্রশংসা করতে হবে! মাথা ঠান্ডা রেখে বাঘটিকে ঘরের মধ্যে থাকা অবস্থায় তালাবন্দি করতে পেরেছিলেন। বাঘটি আপাতত পর্যবেক্ষণে থাকবে। তবে এখনই ওকে রেডিয়ো কলার পরানোর পরিকল্পনা নেই।’
ও দিকে বন্দি বাঘের পালামৌ যাওয়ার খবরে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন পুরন্দরও। ভোরে কৃষ্ণনামটা অন্তত ভয়ে ভয়ে করতে হবে না!