‘বাবাকে খুন করেছি’, গভীর রাতে থানায় ছেলের আত্মসমর্পণ
আনন্দবাজার | ২৬ জুন ২০২৫
খালি গা। পরনে শুধু হাফ প্যান্ট। উদ্ভ্রান্তের মতো থানায় ঢুকল এক প্রৌঢ়। কর্তব্যরত পুলিশকর্মী পথ আটকাতেই প্রৌঢ় ঠান্ডা গলায় বলল, ‘‘বাবাকে খুন করেছি। বডি ঘরে পড়ে আছে!’’
মঙ্গলবার রাত ৩টের সময়ে ওই প্রৌঢ়ের মুখে এমন কথা শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন পুলিশকর্মীরাও। কিন্তু বার বার একই দাবি করছিল ওই প্রৌঢ়। শেষে বরাহনগর থানার পুলিশ ছোটে তার বাড়িতে। গিয়ে দেখা যায়, বিছানায় মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। পুলিশ জানিয়েছে, ওই বৃদ্ধের নাম ললিত অধিকারী (৭৪)। তাঁর ছেলে, বছর বাহান্নর গৌতমকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে তারা।
সূত্রের খবর, প্রাথমিক জেরায় গৌতম দাবি করেছে, বৃদ্ধ বাবার আচরণ সহ্য করতে না পেরেই সে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। রাতে ছেলের পাশের ঘরেই শুয়েছিলেন ললিত। রাত আড়াইটে নাগাদ ওই ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত বাবার মুখে বালিশ চেপে ধরে গৌতম। বাবার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরে কিছু ক্ষণ ঘরেই বসে থাকে সে। তার পরে বরাহনগর থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করে।
বরাহনগর পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের শিশিরকুমার দাঁ রোডে তেতলা বাড়ি ললিতের। বছর তিনেক আগে তাঁর স্ত্রী অঞ্জলির মৃত্যু হয়। বাড়ির নীচে লজেন্স তৈরির কারখানা ছিল ওই বৃদ্ধের। কিন্তু বয়সজনিত কারণে তা আর চালাতে পারতেন না তিনি। তাই কারখানা ভাড়া দেন। ললিতের মেয়ে রেণু ঘোষ দস্তিদার পাশের এলাকাতেই থাকেন।
পরিজনদের থেকে তদন্তকারীরা জেনেছেন, আগে বাবার লজেন্স কারখানা দেখাশোনা করত গৌতম। কিন্তু ব্যবসায় মন ছিল না তার। সারা ক্ষণই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকত। বছর দুয়েক আগে ডানলপ-ব্যারাকপুর রুটে অটো চালাতে শুরু করে গৌতম। তদন্তে পুলিশ আরও জেনেছে, বছর সাতেক আগে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয় গৌতমের। ফের সে বিয়ে করে। এর পরে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বালিতে থাকত গৌতম। তবে, এক মাস ধরে সে বরাহনগরে নিজেদের বাড়িতেই থাকছিল। তার স্ত্রী-ও মাঝেমধ্যে এসে থাকতেন। স্নানযাত্রার দিন বাড়িতে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি এনে প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছিল গৌতম। তাতে আত্মীয়স্বজনও এসেছিলেন।
ওই অনুষ্ঠানের পরে ফের বালিতে ফিরে যান গৌতমের স্ত্রী। কিন্তু বরাহনগরের বাড়িতেই থাকছিল গৌতম। মঙ্গলবার রাতে পুলিশ তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখে, ওই প্রৌঢ়ের ঘরে এসি চলছে। বিছানায় বিভিন্ন নেশার সামগ্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। পাশের ঘরের খাটে পড়ে ললিত। তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা জানান, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। রেণু পুলিশকে জানিয়েছেন, বাবার রান্নার জন্য লোক রাখা ছিল। নিত্য পুজো করতে আসতেন এক জন পুরোহিত। মাঝেমধ্যেই গৌতম অশান্তি করলে তা ফোন করে মেয়েকে জানাতেন ললিত। স্ত্রীর সঙ্গেও অশান্তি লেগে থাকত ওই প্রৌঢ়ের।
বুধবার রেণু বলেন, ‘‘বড় কোনও ঝামেলা ছিল, তেমনটা নয়। তবে, ভাই অল্পেই মেজাজ হারাত। কিন্তু ঠিক কী কারণে বাবাকে খুন করল, তা বুঝে উঠতে পারছি না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ভাই ছোট বয়স থেকেই নেশা করত। সেই নেশাই সব শেষ করে দিল।’’ পুলিশ সূত্রের খবর, জেরায় গৌতম দাবি করেছে, ললিতের বয়সজনিত আচরণ ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠেছিল তার কাছে। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে ঝামেলা লাগছিল। ব্যারাকপুর সিটি পুলিশের উপ-নগরপাল (দক্ষিণ) অনুপম সিংহ বলেন, ‘‘গৌতম যা দাবি করছে, খুনের পিছনে সেটাই একমাত্র কারণ কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’