জানুয়ারি থেকে জুন, কোটির ক্লাবে কি কোনও ছবি পা রাখল? বাংলা বিনোদন দুনিয়ার ভবিষ্যৎ কী?
আনন্দবাজার | ২৬ জুন ২০২৫
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস। ছ’মাসে ছবি মুক্তির তালিকা খুব ছোট নয়। জানুয়ারি মাস শুরু হয়েছে রুক্মিণী মৈত্র অভিনীত ‘বিনোদিনী: একটি নটীর নাম’ দিয়ে। এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য, ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’, ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘কিলবিল সোসাইটি’, ‘পুরাতন’, ‘আড়ি’, ‘আমার বস’, ‘সোনার কেল্লায় যকের ধন’, ‘পক্ষীরাজের ডিম’, ‘অঙ্ক কী কঠিন’ ‘বাৎসরিক’, ‘রাস’, ‘গৃহপ্রবেশ’। ছবি মুক্তির পাশাপাশি নানা ঘটনার ঘনঘটা দেশে, বিশ্ব জুড়ে। পহেলগাঁও কাণ্ড, তার জেরে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব, বিশ্বে যুদ্ধের আবহ। যার প্রভাব ছায়াছবিতে পড়বে— আশঙ্কা ছিল প্রযোজক, পরিচালক, পরিবেশকদের।
সত্যিই কি অস্থির পরিস্থিতির কোনও প্রভাব বাংলা বিনোদন দুনিয়ায় পড়েছে?
আনন্দবাজার ডট কমের হাতে এসেছে জাতীয় মাল্টিপ্লেক্সের পরিসংখ্যান তালিকা। সেই তালিকা অনুযায়ী, কোটির ক্লাবে পা রাখতে পেরেছে মাত্র দুটো ছবি। জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের ‘দ্য একেন: বেনারসে বিভীষিকা’, নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বস’। এর মধ্যে ‘একেনবাবু’ দেব প্রযোজিত এবং অভিনীত ‘খাদান’ ছবির রেকর্ড ভেঙে পাঁচ সপ্তাহে ৩.১২ কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে। আট সপ্তাহে দেবের ছবিটি আয় করেছিল ২.৮৩ কোটি টাকা। তালিকায় বাকি ছবিগুলোর কোনওটি প্রায় কোটি ছুঁই ছুঁই, কোনওটি কোটির থেকে অনেকটাই দূরে। যেমন, ‘কিলবিল সোসাইটি’র আনুমানিক আয় ৯৬ লক্ষ, ‘পুরাতন’ ৬৬ লক্ষ, ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ ৫৫ লক্ষ, ‘এই রাত তোমার আমার’ ৪৭ লক্ষ, ‘সোনার কেল্লায় যকের ধন’ ৪৪ লক্ষ, ‘গৃহপ্রবেশ’ ১৮ লক্ষ (প্রথম সপ্তাহ)।
বক্স অফিস কালেকশন অনুযায়ী বাণিজ্যিক সাফল্যের ছবিটি আরও উজ্জ্বল। ‘একেন’ ব্যবসা করেছে ৭ কোটি, ‘আমার বস’ ৪ কোটি, ‘কিলবিল সোসাইটি’ আড়াই কোটি, ‘পুরাতন’ দেড় কোটি, ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ ১.৩ কোটি। অর্থাৎ, মোট ৫টি ছবি কোটির ক্লাবে। এর মধ্যে দু’টি ছবিই পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের।
ছ’মাসে বাংলা ছবির এই ব্যবসা কতটা আশাজনক? গত বছর নানা কারণে ছবির তৈরির সংখ্যা আচমকা অনেকটা কমে গিয়েছিল। এ বছর কি সেই সংখ্যা বাড়বে?
উত্তর খুঁজতে আনন্দবাজার ডট কম যোগাযোগ করেছিল পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, সৌরভ পালোধি, পরিবেশক বাবলু দামানি, শতদীপ সাহার সঙ্গে। কী বলছেন তাঁরা?
পরিচালনার পাশাপাশি ‘আমার বস’ ছবির নায়ক এবং অন্যতম প্রযোজক শিবপ্রসাদ। ‘আমার বস’ মুক্তির আগের রাত অর্থাৎ, ৮ মে যুদ্ধ ঘোষণা হয়েছিল। ৯ মে আদৌ কোনও ছবি মুক্তি পাবে কি না তাই নিয়ে দ্বিধায় ছিল বিনোদন দুনিয়া। এই কঠিন পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে মুক্তি পেয়েছিল রাখি গুলজ়ারের ছবিটি। এই ছবি দিয়ে ১৪ বছর পর বাংলা ছবিতে ফিরেছেন তিনি। শিবপ্রসাদের কথায়, “ওই রকম পরিস্থিতিতে দর্শক হল ভরিয়ে ছবি দেখেছেন। আমি কৃতজ্ঞ।”
তিনি কিন্তু এই পরিসংখ্যানকে যথেষ্ট আশাপ্রদ মনে করেছেন। তাঁর মতে, এই বছরটা বাংলা ছবির জন্য তুলনামূলক ভাবে ভাল হতে চলেছে। কেন তিনি বাংলা ছবির ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস পাচ্ছেন? পরিচালকের কথায়, “এ বছর বাংলা ছবিমুক্তির ঢল অনেক বেশি। গত বছর এতটাও ছিল না। দুই, বাংলা সিনেমা কিন্তু হিন্দি সিনেমার তুলনায় সিঙ্গল থিয়েটারকে নিয়মিত ব্যবসা দিয়ে গিয়েছে। তিন, নিয়মিত বাংলা ছবির মুক্তি মানেই প্রেক্ষাগৃহ কখনও খালি নয়। নতুন নতুন বাংলা ছবি আসা মানেই দর্শকের আনাগোনা।” শিবপ্রসাদ তৃতীয় কারণটির উপরে বেশি জোর দিয়েছেন। কারণ, ছবি ক্রমাগত মুক্তি পেতে থাকলে দর্শক কখনও একঘেয়েমিতে ভুগবে না। নানা স্বাদের ছবি দেখতে দেখতে আখেরে তার আগ্রহ বাড়বে।
সেই রেশ ধরে রাখতে ছবি মুক্তির তালিকায় জুড়তে চলেছে ‘ডিয়ার মা’, ‘মৃগয়া’, ‘ভূতপূর্ব’র মতো ছবি। অর্থাৎ, দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে বারে বারে ফিরিয়ে আনার ধারা এ বছর বাংলা ছবি ধরে রাখতে পেরেছে। যা তারকাখচিত হিন্দি ছবি করে দেখাতে পারেনি, জানিয়েছেন প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতা। সেই জায়গা থেকে এ বছর বাংলা ছবি এখনও পর্যন্ত যা আয় করেছে তা যথেষ্ট সন্তোষজনক। শিবপ্রসাদ আলাদা করে উল্লেখ করেছেন রানা সরকার প্রযোজিত ‘অঙ্ক কী কঠিন’ ছবির কথা। ছবিতে তথাকথিত তারকা নেই। ছোট বাজেটের ছবি। প্রথমে কম প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল। দর্শকদের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে সেই ছবি বাণিজ্যে সাফল্যের মুখে দেখেছে।
এমন মিরাকল ঘটবে আগাম বুঝতে পেরেছিলেন ‘অঙ্ক কী কঠিন’ ছবির পরিচালক সৌরভ পালোধি? পরিচালক স্বীকার করেছেন, তিনি এতটাও আশা করেননি। পাশাপাশি, বাংলা ছবির ছ’মাসের সার্বিক পরিসংখ্যান নিয়েও মতামত দিয়েছেন। সৌরভের কথায়, “বাংলা ইন্ডাস্ট্রির জন্য ‘একেন’, ‘আমার বস’ বা ‘খাদান’-এর মতো ছবির প্রয়োজন রয়েছে। এই ধরনের ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য বেশি। দর্শকও তারকাখচিত বড় বাজেটের ছবি দেখতে পছন্দ করেন।” এই ধরনের ছবি ব্যবসায়িক সাফল্য পেলে ‘অঙ্ক কী কঠিন’-এর মতো ছবিগুলো বেঁচে থাকবে অনেক দিন ধরে। বানানোর সুযোগ তৈরি হয়। পরিচালকেরা শুধু নিজের তৃপ্তির কথা ভেবে ছবি বানালে টলিউডের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। পাশাপাশি, সৌরভ জোর দিয়েছেন বাস্তবধর্মী ছবি বানানোর দিকে। তাঁর মতে, এখনকার শিক্ষিত দর্শক এই ঘরানার ছবিই দেখতে চান। তার পরেই তাঁর আফসোস, বাংলায় এই ধারার ছবি হলে ব্যবসায় ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’। হিন্দি ছবির ক্ষেত্রে একই বিষয় কিন্তু হল ভরিয়ে দেখেন!
খবর, সৌরভ ইতিমধ্যেই নাকি পরের ছবির চিত্রনাট্য ঘষামাজা শুরু করে দিয়েছেন। আগামী ছবিও কি ছোট বাজেটের তারকাহীন ছবি বানাবেন?
হাসতে হাসতে পরিচালকের জবাব, “আমি অঙ্কের ছাত্র ছিলাম। তাই হিসাব ভালই বুঝি। সেই দিক থেকেই বলছি, অকারণ বাজেট বা়ড়িয়ে, অনেক তারকা নিয়ে ছবি বানানোর পক্ষপাতী নই। ছোট মাপের ছবি কিন্তু ব্যবসায় ভাল ফল দেয়।” যদিও স্বপ্ন দেখেন, পায়ের নীচের জমি শক্ত হলে বড় বাজেটের ছবিও হয়তো এক-আধটা বানিয়ে ফেলবেন!
যে কোনও ক্ষেত্রেই প্রথম ছ’মাসের ফলাফল সন্তোষজনক হলে পরের ছ’মাস আশাপ্রদ, মনে করেন বিচক্ষণেরা। এই মত সমর্থন করেছেন পরিবেশক, হলমালিক শতদীপ সাহা। তাঁর কথা, “একটা ভুয়ো খবর গত কয়েক বছর ধরে বাজারে ঘুরছে। বাংলা ছবির নাকি অবস্থা খুব খারাপ। পরিবেশক হিসাবে বলছি, এই কথা সত্যি নয়। গত তিন বছর ধরে কমবেশি একই অঙ্কের ছবি মুক্তি পেয়েছে। বলতে পারেন সেই অনুযায়ী আরও একটু ভাল ফল হওয়া উচিত ছিল।” এ বছর সেই ফাঁক ভরাট হওয়ার সম্ভাবনা এ বছরে যথেষ্ট রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি। কারণ, প্রথম ছ’মাসে সাতটি ছবির ফলাফল আশাজনক।
এই মতেই কি সায় দেবেন ‘একেনবাবু’র পরিচালক জয়দীপও? তাঁর ছবির নায়ক ‘একেন’ অনির্বাণ চক্রবর্তীকে এখন ‘হিট মেশিন’ বলে ডাকা হচ্ছে! জয়দীপ ডাবিংয়ে ব্যস্ত। তার মধ্যেই ফোনে ধরা দিল তাঁর কণ্ঠের উত্তেজনা। খুশি গলায় বললেন, “একটি চরিত্রের জন্য, গল্প শুনতে সব বয়সের মানুষ প্রেক্ষাগৃহ ভরিয়ে ফেলছেন। হল ভিজ়িটে গিয়ে তাঁদের ভালবাসায় ভিজতে ভিজতে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে।” কেন ‘একেন’কে এই প্রজন্মের এত পছন্দ? কারণ, এই প্রজন্ম ‘ফেলুদা’কে পায় না। বদলে ‘একেন’কে পাচ্ছে। তাই বড় পর্দায় তাকে দেখতে আসছে। আগামী দিনে জয়দীপ কি শুধুই ‘একেনবাবু’তে মগ্ন থাকবেন? “একেবারেই না। সব ধারার ছবি বানাব। নইলে আমিও একঘেয়েমিতে ভুগব। দর্শকদেরও একটা সময়ের পর শুধুই ‘একেন’ দেখতে দেখতে বিরক্তি তৈরি হবে।”
রাজকুমার দামানি, টলিউডে তিনি বাবলু দামানি নামে পরিচিত। এই মুহূর্তে ‘আমার বস’, ‘রাস’ ছবির পরিবেশনার দায়িত্বে তিনি। বাংলা ছবির ছ’মাসের চালচিত্র দেখে তিনিও কি বাকিদের মতোই আশাবাদী? “অবশ্যই”, ছোট্ট জবাবে নিজের মনের কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। জানিয়েছেন নন্দন, রাধা স্টুডিয়োয় মুক্তি না পেলেও ‘রাস’ও ভালই ফল করছে। এই ছবির ব্যবসা ৫০ লক্ষ ছুঁয়েছে।
এক দিকে ছোট বাজেটের, অভিনেতাসর্বস্ব ছবি। অন্য দিকে, বড় বাজেটের তারকাখচিত মশালা ফিল্ম। ব্যবসায়িক সাফল্য পেতে আগামী দিনে কোন ধারার দিকে ঝুঁকবেন প্রযোজক-পরিচালক?
বাবলুর কথায়, “ছবি সব স্বাদের, সব ঘরানার বানাতে হবে। গল্পনির্ভর, রহস্যরোমাঞ্চ, পারিবারিক, প্রেম, ভৌতিক, ছোট বা বড় বাজেটের ছবি— সব মজুত রাখতে হবে প্রযোজক, পরিচালকদের। কারণ, দর্শকদের কখন কোনটা ভাল লাগবে কে বলতে পারে?” বাকিদের মতো বাবলুও জানেন, তাই ছবি হিট করানোর কলকাঠি শুধুই ‘জনতা জনার্দন’নের মুঠোবন্দি।