• ‘রাস্তায় ভাঙা কাচ, মাথার উপর ফাইটার জেট’, অভিজ্ঞতা শোনালেন ইজ়রায়েল-ফেরত অনিরুদ্ধ
    এই সময় | ২৭ জুন ২০২৫
  • ‘যুদ্ধ তখন চলছে। সকাল ৮টা বাজে। হঠাৎ অ্যালার্ম বেজে উঠল। তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তীব্র শব্দ...’, বৃহস্পতিবার সকালে নিজের বাড়িতে বসেও আতঙ্ক যেন পিছু ছাড়ছিল না। ইজ়রায়েলের যুদ্ধ পরিস্থিতির কথা বলার সময়ে অনিরুদ্ধের চোখেমুখে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল উদ্বেগের ছাপ। দিল্লি বিমানবন্দর থেকে কলকাতা হয়ে এ দিন সকালে শালবনির ভাউদি গ্রামের বাড়িতে পৌঁছেছেন ইজরায়েলের তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অনিরুদ্ধ বেরা। তাঁকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন বাবা-মা। আর অনিরুদ্ধ কী বলছেন? তাঁর মুখে শোনা গেল ভারতীয় দূতাবাসের ভূয়সী প্রশংসা।

    ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধ পরিস্থিতি যখন গভীর সঙ্কটে, তখনই ‘অপারেশন সিন্ধু’ চালু করে ভারত। ইরান ও ইজ়রায়েলে আটকে পড়া ভারতীয়দের দেশে ফেরত আনার জন্য শুরু হয়েছিল এই অপারেশন। তার মাধ্যমেই দেশে ফিরেছেন অনিরুদ্ধ। কিন্তু সেটাও সহজ হয়নি। প্রথমে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেননি তিনি। সেই কারণে ইজ়রায়েল থেকে জর্ডন হয়ে ভারতে ফেরা প্রথম বিমানে তিনি জায়গা পাননি। ১৩ জুন ভোর থেকে ইজ়রায়েল-ইরানের যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯ জুন রেজিস্ট্রেশন করেন তিনি। তার পরে শনিবার আমেরিকাও ইরানের উপর হামলা করায় পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে উঠেছিল। আতঙ্কের পরিস্থিতির মাঝেই রবিবার বিকেলে ভারতীয় দূতাবাসের তরফে তিনি জানতে পারেন যে দেশে ফিরতে চলেছেন তিনি। ২৩ জুন, সোমবার ভারতীয় সময় সকাল ১১টা নাগাদ ইজ়রায়েলের তেল আভিভ থেকে অনিরুদ্ধ-সহ প্রায় ৩০০ জনকে নিয়ে বিশেষ বাস রওনা দেয় মিশরের শার্ম-এল-শেখ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। সোমবার গভীর রাতে ভারতীয় বায়ুসেনার বিশেষ বিমান (C-17 Globemaster) অনিরুদ্ধদের নিয়ে দিল্লি পাড়ি দেয়। মঙ্গলবার বেলা ১২টা দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছয় ভারতীয় বায়ুসেনার বিমান। অনিরুদ্ধদের নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লির বঙ্গভবনে। বুধবার গভীর রাতে দিল্লি বিমানবন্দর থেকে কলকাতাগামী বিমানে ওঠেন মেদিনীপুরের শালবনির ছেলে অনিরুদ্ধ। বৃহস্পতিবার ভোর ৩টা নাগাদ পৌঁছন কলকাতায়। এরপর, সাঁতরাগাছি স্টেশন থেকে রূপসী বাংলা ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরা। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ ভাউদি গ্রামে নিজের বাড়িতে পৌঁছন অনিরুদ্ধ। তাঁকে দেখে তাঁর বাবা-মার চোখ তখন জলে ভাসছে।

    বৃহস্পতিবার বিকেলে ভাউদি হাইস্কুল থেকে অনিরুদ্ধকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। বাড়ির পাশের ওই স্কুল থেকেই ৯০ শতাংশ নম্বর পেয়ে ২০১৪ সালে মাধ্যমিক পাস করেছিলেন অনিরুদ্ধ। মেধাবী ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায় ছিলেন শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। অনিরুদ্ধ বলেন, ‘এখনও প্রায় দু’বছর গবেষণার কাজ বাকি। তাই দুই-তিন সপ্তাহ পরিস্থিতি দেখে ফেরার সিদ্ধান্ত নেব।’

    আমেরিকা হামলা করার পরেই ইজ়রায়েলে মিসাইল বর্ষণ শুরু করেছিল ইরান। সেই সময়েই দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন তিনি। জানিয়েছেন বিপদঘণ্টি বাজার অভিজ্ঞতার বিষয়টিও। তিনি বলেন, ‘একদিন সকাল ৮টা নাগাদ অ্যালার্ম বাজে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা তীব্র শব্দ হয়। তখন আর আমাদের আবাসনের শেল্টার নিরাপদ মনে হয়নি। প্রায় দু’শো মিটার দূরে অবস্থিত বাঙ্কারে দৌড়ে যাই। রাস্তায় ভাঙা কাচ পড়েছিল। উপর উড়ছে ইজ়রাইলের যুদ্ধবিমান। আমরা যেখানে কফি খেতে যেতাম, বাজার করতে যেতাম, সেই জায়গাগুলোও দেখলাম অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। তখনই আমরা ভাবি এ বার ফিরতেই হবে!’ তাঁর মতে, ইজ়রায়েলের বাসিন্দারাও জানিয়েছেন, এর আগে বহুবার যুদ্ধে জড়িয়েছে ইজ়রায়েল। কিন্তু এ ভাবে টানা মিসাইলের টার্গেট হয়নি তাঁদের দেশ।

    তবে অনিরুদ্ধ জানাচ্ছেন, যুদ্ধ পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠলেও অতটাও নাকি ভয়ের ছিল না। তাঁর দাবি, ‘ইজরায়েলের বাসিন্দাদের যুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমরাও থাকতে থাকতে সেই প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেলেছি। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা ইজরায়েলের বাসিন্দাদের সমুদ্র সৈকতে ফুটবল খেলতে দেখেছি, পার্টি করতেও দেখেছি। তাই এখানে বাবা-মা’র যতটা দুশ্চিন্তা হয়, আমার ততটা নয়।’ তবে তাঁর আসল ভরসা ভারত সরকার। গবেষক পড়ুয়া বলছেন, ‘ইজরায়েলের শক্তির উপর ভরসা আছে। আর সবথেকে বড় কথা, আস্থা আছে ভারত সরকারের উপর। যদি আবারও কখনো এই ধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতি আসে, আমরা নিশ্চিত ভারত সরকার আবারও আমাদের নিরাপদে ফেরাবে।’

    অনিরুদ্ধর মা রাখি বেরা বলেন, ‘খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। খাওয়া-দাওয়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ছেলে বাড়ি ফিরেছে খুব খুশি। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’ বাবা অসীম কুমার বেরা বলেন, ‘যখন টানা যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তখন সত্যিই গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। চাইব, নিজের গবেষণা শেষ করে ভালোভাবে ও ফিরে আসুক।’

  • Link to this news (এই সময়)