শ্যামল সেন, হলদিয়া: মহিষাদলে রথ-সংস্কৃতি শতাব্দী প্রাচীন এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত। এককালে মহিষাদল রাজবাড়ি এবং রামবাগের দেওয়ানবাড়ির ব্যবস্থাপনায় চারটি রথ টানা হতো। এর কোনওটি রথযাত্রার সময়, কোনও রথ আষাঢ়ে পূর্ণিমায় আবার কোনও রথ টানা হয় বিজয়া দশমীতে। কালের নিয়মে মহিষাদলের রাজ রথ এখন ভক্তের রথ, জনসাধারণের রথে পরিণত। যদিও রাজবাড়ি বা দেওয়ান পরিবারের পুরনো রীতি মেনেই রথ টানা হয়। রথের মাঙ্গলিক আচার অনুষ্ঠান প্রথামতো রাজবাড়ি পরিচালনা করে। আজও রথের আমন্ত্রণ জানান রাজ পরিবারের দুই সদস্য শঙ্করপ্রসাদ গর্গ ও হরপ্রসাদ গর্গ। তবে রথ ঘিরে মেলা ও অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকে স্থানীয় প্রশাসন এবং এলাকার বাসিন্দারা।
মহিষাদলের রাজবাড়ির রথ এবং দেওয়ানজির রথ দু’টিই আজকের দিনে ‘চলমান হেরিটেজ’ হিসেবে পরিচিত। কাঠের তৈরি দু›টি রথই প্রত্নবস্তু এবং রাজ্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বিশেষজ্ঞদের দাবি, মহিষাদল রাজবাড়ির কাঠের তৈরি দু›শো বছরের বেশি পুরনো রথ আর কোথাও সচল অবস্থায় নেই। অগ্নিকাণ্ড সহ নানা কারণে দেড়শো বছরের ওই রথের একাধিকবার সংস্কার হলেও কখনও আমূল বদল হয়নি। দু›শো বছরের পুরনো কাঠের মূল কাঠামোর সিংহভাগই অটুট রয়েছে। ছ’তলা বাড়ির সমান ১৩ চূড়ার উঁচু প্রায় একশো টন ভারি কাঠের রথ কীভাবে এখনও সচল, সেটাও এক বিস্ময়! অন্যদিকে, মহিষাদল রাজবাড়ির অদূরে দেওয়ান পরিবারের ছোট আকারের কাঠের রথও শতাব্দী প্রাচীন। একইভাবে, ওই রথের সংস্কার হলেও আমূল বদলায়নি কখনও।
মহিষাদলের দুই আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক হরিপদ মাইতি ও অর্ণব রায় বলেন, মহিষাদলের কাঠের তৈরি দু’টি রথ গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তু। এগুলির সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং অবশ্যই বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু রাজ্য নয়, দেশের কোথাও এত বিশাল আকারের পুরনো রথের কাঠামো সচল অবস্থায় নেই। এমন ঐতিহ্যময় প্রত্নবস্তুকে রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকারের তরফে হেরিটেজ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন এই দুই গবেষক। তাঁদের বক্তব্য, রথযাত্রার সময় রথের সংস্কার হলেও সামগ্রিকভাবে এর বিজ্ঞানভিত্তিক সংরক্ষণ জরুরি। রথ সচল রাখতে এর স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রয়োজন।
মহিষাদলের রথের হেরিটেজ তকমা পেতে একাধিকবার বিধানসভায় সরব হয়েছেন স্থানীয় বিধায়ক তিলক চক্রবর্তী। বিধায়ক বলেন, কাঠের রথের সংস্কারের খরচ প্রচুর। প্রতিবছর ৬-১০ লক্ষ টাকা খরচ হচ্ছে। ২০১৭ সাল থেকে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে এই রথ সংস্কারে। বিপুল পরিমাণ খরচ বহন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। হলদিয়ার আইওসি জেলার হেরিটেজ সংরক্ষণে আগ্রহী বলে জেনেছি। আইওসি রিফাইনারি কর্তৃপক্ষের কাছে এজন্য আবেদন জানাব।
কারণ শতাব্দী প্রাচীন এই রথ ও রথের মেলার জন্য রাজ্যে প্রসিদ্ধ মহিষাদল। মহিষাদলের রথের সূচনাকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। রানি জানকীদেবীর সময়ে ১৭৭৬ কিংবা ১৭৭৮ সাল নাগাদ রথ তৈরির পরিকল্পনা ও খরচের বাজেট হয়েছিল। ১৮০৪ সাল নাগাদ সম্ভবত রথ উৎসব শুরু হয়। রথের চাকাগুলি এক লাইনে নেই।
আগে এই চাকার উচ্চতা ছিল প্রায় সাড়ে ৬ ফুট, এখন তা কমে ৪ ফুট হয়েছে। মহিষাদলের রথের চাকার বৈশিষ্ট্য, এখানে কোনও স্পোক নেই, নিরেট কাঠের তৈরি রথ। এবছর রাজবাড়ির ২০০ বছরের পুরনো নিমকাঠ দিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন ছয় চাকা। রাজবাড়ির কুলদেবতা মদনগোপালজিউর নামে পরিচিত মহিষাদলের রথ। অন্যদিকে, বিজয়াদশমীতে দেওয়ান পরিবারের রথ রামজিউর রথযাত্রা নামে পরিচিত।-নিজস্ব চিত্র