গৌতম ধোনি, মায়াপুর
আম-জাম-কাঁঠাল, আপেল, আঙুর, অন্ন, পরমান্ন, লুচি, হরেক রকম ভাজা, জিলিপি, রসগোল্লা, পান্তুয়া, সরপুরিয়া। রসালো ফল, সুস্বাদু খাদ্য তালিকাটি কোনও অনুষ্ঠানের নয়। রথযাত্রার সময়ে এই খাবারগুলো সুন্দর ও সুসজ্জিত ভাবে নিবেদন করা হয় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে।
সোজা রথ আর উল্টোরথের মাঝের সাতদিন মাসির বাড়িতে ভালোবাসায় মুড়ে ফেলা হয় তিন হিন্দু দেবদেবীকে। সারা বছর এই রথের দেবদেবী — জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা থাকেন মায়াপুর ইসকন মন্দির থেকে প্রায় পাঁচ কিমি দূরে রাজাপুর গ্রামের জগন্নাথ মন্দিরে।
কিন্তু রথ উপলক্ষে তাঁদের জন্য এই বিশেষ আপ্যায়ন হয়ে থাকে মাসির বাড়িতে। ৫৬ ভোগ নিবেদন করা হয় তাঁদের। মজার বিষয়, পূর্ব উল্লেখিত খাবারের পাশাপাশি দেবদেবীদের নিবেদন করা হয় চাউমিন, পাস্তা, বার্গার, ক্রিমরোল, ডোনাটও। সব আইটেমই মন্দিরের নিজস্ব কিচেনে নিরামিষ উপকরণ দিয়ে তৈরি।
একটা, দুটো নয়। দেবদেবীর জন্য তিনটে আলাদা রথ থাকে নদিয়ার মায়াপুরের ইসকনে। ভক্তদের দর্শন দিতে একই দিনে, একই সময়ে রাজপথে যাত্রা শুরু করেন তাঁরা। পাশাপাশি নিয়ে যাওয়ার মতো চওড়া রাস্তা মেলে না বলে আগু-পিছু করে নিয়ে যাওয়া হয়।
মাসির বাড়িতে পৌঁছে অবশ্য একসঙ্গেই থাকেন তাঁরা। সোজা থেকে উল্টো রথের মাঝের কয়েক দিনে মাসির বাড়িতে দেবদেবীকে বিভিন্ন ফলাহার, চাউমিন, পাস্তা, বার্গার, ক্রিমরোল, ডোনাটও উৎসর্গ করা হয়। রথ দর্শনে এসে দেশ-বিদেশের ভক্ত ও পর্যটকরা মন্দিরনগরী মায়াপুর, নবদ্বীপ ঘুরে দেখেন বলে প্রায় দু'সপ্তাহ ধরে চৈতন্যধামে বাড়তি ভিড় থাকে।
ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা অভয়চরণ ভক্তিবেদান্ত স্বামী ১৯৬৭-তে আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকো শহরে রথযাত্রার আয়োজন করেছিলেন। তারপর একে একে বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত ইসকনের সব শাখাতেই শুরু হয় এই রীতি।
চৈতন্যধাম মায়াপুর, ইসকনের ওয়ার্ল্ড হেড কোয়ার্টার (স্পিরিচুয়াল) হওয়ায় এখানে বছরের অন্য উৎসবগুলোর মতো রথযাত্রা জাঁকজমকও বেশ নজরকাড়া। সারা বছর এই রথের জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা থাকেন মায়াপুর ইসকন মন্দির থেকে প্রায় পাঁচ কিমি দূরে রাজাপুর গ্রামের জগন্নাথ মন্দিরে।
এ বার সোজা রথ ২৭ জুন, শুক্রবার। এ বারেও রাজাপুর গ্রামের জগন্নাথ মন্দির লাগোয়া মাঠ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে রথের টান হবে দুপুর দুটোয়। পথে ঝাড়ু দিয়ে যাত্রাপথ পরিষ্কার করে এগোবেন ভক্তরা। সঙ্গে রয়েছে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা।
প্রায় পাঁচ কিমি রাস্তা পেরিয়ে মায়াপুর ইসকনের মূল মন্দিরে শেষ হবে যাত্রা। এখানে উল্টোরথ আগামী ৫ জুলাই, শনিবার। ওই দিন একই পথ অনুসরণ করে একই আয়োজন করে রাজাপুরের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হবে তিন দেবদেবীকে।
রাজাপুরের জগন্নাথ মন্দিরটি শতাব্দী প্রাচীন। একটা সময়ে এই এলাকার প্রায় ৫০০ বসতির বৈষ্ণবরা মায়াপুর পর্যন্ত রথ টেনে আনতেন। মাঝে দীর্ঘ বছর সেই রীতি বন্ধ ছিল। ১৯৭৯ থেকে ইসকনের হাত ধরে সেই উৎসব পুনরায় চালু হয়। ১৯৯৮ থেকে এই উৎসবের জৌলুস বেড়েছে।
ইসকনের এই রথ তুলনায় বয়সে নবীন হলেও জেলা, রাজ্য, দেশের বেড়া ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিক পরিচিতিও ও খ্যাতি অর্জন করেছে। মায়াপুর ইসকনের জনসংযোগ আধিকারিক রসিক গৌরাঙ্গ দাস বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পাসে পৃথিবীর ৮০টি দেশের প্রায় ১২০০ কৃষ্ণভক্ত রয়েছেন। রথ উপলক্ষে আরও বিদেশি ভক্ত আসতে পারেন। সাত দিনের উৎসবে ভক্তদের ঢল প্রায় পাঁচ লক্ষ ছুঁয়ে যাবে আমাদের অনুমান।’
রসিক গৌরাঙ্গের বক্তব্য, ‘মায়াপুর ইসকনের মূল মন্দির ক্যাম্পাসে অস্থায়ী গুন্ডিচা মন্দির গড়া হয়। এ বছর পঞ্চতত্ত্ব মন্দির আঙিনায় সেই মন্দির গড়া হচ্ছে। সেখানেই রোজ দেবদেবীকে ৫৬ ভোগ নিবেদন করা হবে।’
দীপ দান, জগন্নাথ অষ্টকম-স্তোত্র পাঠ, ভজন, কীর্তন, নাটক ও নাচের অনুষ্ঠানও রয়েছে। ছোটরা ভিড়ের মধ্যে রথের দড়ি টানতে পারে না বলে ২৯ জুন, রবিবার বিকেলে শিশুদের জন্য মূল মন্দির ক্যাম্পাসে একটি বিশেষ রথযাত্রার আয়োজনও হয়েছে এই বছর।
দেবদেবীকে ৫৬ ভোগ নিবেদন প্রসঙ্গে রসিক গৌরাঙ্গ বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব কিচেনে শুদ্ধাচারে নিরামিষ উপকরণ দিয়ে তৈরি হয় এই বিশেষ ভোগ। দেশীয় ভক্ত ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভক্ত এখানে রয়েছেন।
তাঁরাও তাঁদের পছন্দের পদ বানিয়ে দেবদেবীকে নিবেদন করে থাকেন। সে জন্যই চাউমিন, পাস্তা, বার্গার, ক্রিমরোল, ডোনাট ইত্যাদিও নিবেদন হয় এই দেবদেবীদের কাছে।’