কবি বিষ্ণু দে-র একটি কাব্যগ্রন্থের নাম ‘সংবাদ মূলত কাব্য’। এই কথাটি প্রায় একটি প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এ কথা শুনলে একজন সংবাদকর্মীর মনে সংশয় তৈরি হতে পারে। কবিতার সঙ্গে তো সংবাদের বিস্তর পার্থক্য। তাহলে এরকম কথা কেন! আসলে এই শব্দবন্ধের মধ্যে থেকে যে মর্মটি উঠে আসে, তা হল সংবাদপত্রের ভাষার শৈল্পিক দিক এবং সাহিত্যের সঙ্গে তার যোগসূত্রটিকে মনে করিয়ে দেওয়া।
সংবাদপত্রের সংবাদ পরিবেশনের ভাষা খুব সাবলীল ও স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন, যাতে একজন অতি সাধারণ পাঠকও একবার তা পড়ার পরই যেন প্রাঞ্জলভাবে বিষয়টি বুঝতে পারেন। প্রথমত সংবাদ পরিবেশন এমনভাবে হওয়া উচিত, যাতে কোনও একটি ঘটনা এবং তার আপাত বিশ্লেষণ যেন পাঠকের মনে সহজে পৌঁছতে পারে। সেই লেখাটির ভাষা যেমন সহজ-সরল হওয়া প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন তা নির্ভুলভাবে লেখা। বাংলা সংবাদপত্রের একটি সংবাদকে সেইভাবে উপস্থাপিত করতে হলে একজন সংবাদকর্মীর বাংলা ভাষার উপর দখল থাকা বিশেষ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন একটি সংবেদনশীল ও বিশ্লেষণধর্মী মননেরও। সংবাদের মধ্যে দুর্বোধ্যতা এবং সরসতার অভাব ওই সংবাদ লেখকের দক্ষতার অভাব বলেই ধরে নিতে হবে।
প্রকৃত সাহিত্যপাঠের মধ্যে দিয়ে একজন ব্যক্তি সেই ভাষায় লেখার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। সাহিত্যপাঠ না থাকলে একজন ভালো সংবাদকর্মী বা সংবাদ লেখক হওয়া সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে তাঁকে বানান সম্পর্কেও সচেতন থাকা প্রয়োজন। বিশেষ বিশেষ শব্দের ব্যবহার এবং বাক্যগঠনের শিক্ষা সাহিত্যপাঠ না থাকলে সম্ভব নয়। সংবাদের সঙ্গে সাহিত্যের এভাবেই একটি চিরাচরিত সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। দেখা যায়, বহু সংবাদপত্রের ঘটনা কথাসাহিত্যের বা কবিতার উপকরণ হয়ে উঠেছে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক সন্তোষকুমার ঘোষ একজন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক। তাঁর বহু গল্প এবং উপন্যাস শিক্ষিত পাঠকদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল। তিনি একসময় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র মূল দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় ওই সংবাদপত্রে কর্মরত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মতো লেখকরা বিভিন্ন সময় বিশেষ বিশেষ প্রতিবেদন লিখতেন। তাঁদের আনন্দবাজারে নিয়ে এসেছিলেন সন্তোষকুমার ঘোষই। তার ফলে ওই সংবাদপত্রে পরিবেশিত সংবাদ চিরাচরিত ধারনাকেই বদলে দিয়েছিল। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, রমাপদ চৌধুরীর মতো কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন ওই সংবাদপত্রে। গৌরকিশোর ঘোষের নাম আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি যেমন একটি আপোসহীন শ্রদ্ধেয় নাম, তেমনি অন্যদিকে ফিচার লেখায় এবং কথাসাহিত্য রচনায় ছিলেন একটি অগ্রগণ্য নাম।
এছাড়াও সত্তরের দশকে ‘যুগান্তর’ সংবাদপত্রের সংবাদ বিভাগে কাজ করতেন অমিতাভ চৌধুরী, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রফুল রায়, কৃষ্ণ ধর, কিন্নর রায়, মৃদুল দাশগুপ্ত প্রমুখ কথাসাহিত্যিক ও কবিরা। একজন বাঙালি লেখক বা কবির বাংলা ভাষার উপর দখল নিয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশ থাকে না, অন্যদিকে তাঁর সংবেদনশীলতা ও বিশ্লেষণধর্মী মননও তাঁর সম্পদ। সুতরাং এরকম একজন কবি বা লেখক সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে যে কৃতিত্ব দেখাবেন, তা বলাই বাহুল্য। তবে কবিতা বা গদ্যসাহিত্যের ক্ষেত্রে যে অন্তর্লীন আবেগ কাজ করে, সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে তা হয় অনেকটাই সংযত এবং নিরপেক্ষ। এইরকম গুণের অধিকারী একজন সংবাদকর্মী খুব সহজেই সংবাদের মূল বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেন এবং তা মানুষের কাছে তুলে ধরতে সফল হন।
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, একটি সংবাদপত্র শহুরে শিক্ষিত মানুষ যেমন পড়ছেন, তেমনি গ্রামের শিক্ষিত মানুষও তা পড়ছেন। আবার শহরের অল্পশিক্ষিত মানুষ চায়ের দোকানে বসে যেমন একটি খবরের কাগজ পড়েন, তেমনি গ্রামের একজন অল্পশিক্ষিত মানুষও তা-ই করেন। সুতরাং একটি সংবাদ এমনভাবে পরিবেশিত হওয়া উচিত, যেন তা সমস্ত শ্রেণীর মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে। এই কাজটি বড় সহজ নয়। তাই একজন সংবাদকর্মীকে সংবাদের ভাষা এবং পরিবেশন শৈলীর ক্ষেত্রে দক্ষ হতে হয়। ভাষার প্রবাহ এমন হবে, যেন একজন পাঠক তা পড়তে শুরু করলে শেষ পর্যন্ত না গিয়ে থামতে পারবেন না। আর এজন্যই একজন সংবাদ লেখককে একজন ভালো সাহিত্যপাঠক হতেই হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদ লেখার ক্ষেত্রে যে সমস্যাটি চোখে পড়ছে, তা হল তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশ ছেলেমেয়ের মধ্যে শুদ্ধ বানানে বাংলা লেখার দক্ষতার অভাব। সেই সঙ্গে ভাষা ও সাহিত্য সংক্রান্ত বিষয়ের জ্ঞান তেমন গভীর না হওয়ায় তাদের লিখিত সংবাদটি অনেক ক্ষেত্রে আড়ষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে তা পাঠককে টেনে রাখতে পারে না। এমনিতেই বিভিন্ন সমাজমাধ্যম এবং টেলিভিশনের সুবাদে মানুষ বিভিন্ন খবর জেনে যাচ্ছেন খুব দ্রুত। ফলে পরের দিন সেই খবর কেন একজন পাঠক পড়বেন, তা নিয়ে ভাবা দরকার। আর সেজন্যই সংবাদ পরিবেশনের মধ্যে খানিকটা গল্পের মতো সাবলীলতা এবং বিভিন্ন দিক থেকে তার বিশ্লেষণ থাকা দরকার। শুধুমাত্র নীরস সংবাদ পরিবেশনই একজন পাঠককে ওই সংবাদের গভীরে নিয়ে যেতে বা তাঁর ভাবনায় অন্য কোনও মাত্রা যোগ করতে পারবে না। একই সঙ্গে একজন সাহিত্যকর্মী ও সংবাদকর্মী হিসেবে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, এই ভাবনা তারই প্রকাশমাত্র। তরুণ প্রজন্মের সংবাদকর্মীরা বিষয়টি ভেবে দেখলে তাঁরা উপকৃত হবেন।