সুমন ঘোষ, দাঁতন
গোলক দাসের ভাঙা রথ! এমন কথা শুনেছেন কখনও? তেমন রথে চড়েই মাসির বাড়ি যেতেন জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরাম। হোক না ভয়ের। না, হয় মাঝে হাঁটতে হবে। সমস্যা কী? এমনই অভিনব রথের কথা শোনা গেল দাঁতনে। তাই বলে গোলক দাসের ভাঙা রথ!
প্রত্যেক বছর রথের দিন তিন ভাইবোন সমস্ত নিয়ম মেনে মাসির বাড়ির পথে রওনা দিতেন ভাঙা রথেই। তৎকালীন সময়ে রাস্তা বলতে কাঁচা রাস্তা। খানাখন্দ ভরা। বৃষ্টি হলে জল-কাদায় ভরে থাকত। রথও ছিল কাঠের।
আর খন্দ পথে রথ চলতে চলতে কখনও খন্দ পথে কাদায় আটকে যেত রথের চাকা। আবার কখনও তা ভেঙে পড়ত। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে রথ থেকে নামিয়ে কাঁধে চড়িয়ে নিয়ে যেতে হতো মাসির বাড়ি।
নিজের বাড়ির রথের কাহিনি শোনাতে শোনাতে দাঁতনের পলাশিয়ার জমিদার বাড়ির বর্তমান প্রজন্ম শুভাশিস দাস মহাপাত্র বেশ কিছু তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘বাবার কাছে শুনেছি, এক সময়ে প্রত্যেক বছর নাকি কিছুটা যাওয়ার পরে রথের চাকা ভেঙে পড়ত।
তারপর কাঁধে করে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে নিয়ে যাওয়া হতো মাসির বাড়ি। যেহেতু তখনকার কাঠের রথটি স্থানীয় গোলক দাস দান করেছিলেন, তাই সবাই রসিকতা করে বলতেন গোলক দাসের ভাঙা রথ।’
পলাশিয়ার রাধারমণ দাস মহাপাত্রের পুত্র শুভাশিসের বয়স এখন পঁয়ষট্টি। তিনি জানান, তাঁর ঠাকুরদা রমাপতি দাস মহাপাত্র ছিলেন পলাশিয়ার জমিদার। তখনও জমিদারি প্রথার বিলোপ হয়নি। পলাশিয়া, আঙুয়া, শরশঙ্কা এলাকায় ছিল তাঁদের জমিদারি।
সেই সময়ে কোনও একজনের বিয়ের হলুদ তেলের বিনিময়ে বকুলতলার কাছে থাকা জগন্নাথ মন্দির এবং প্রভু জগন্নাথের সেবার জন্য ৩৬৫ বিঘে জমি দান করেছিলেন জেনকাপুরের রায়েরা। তাঁরা আরও বড় জমিদার ছিলেন। দাঁতন এলাকার অনেক জগন্নাথ মন্দির তাঁদেরই দান করা বলে জানান শুভাশিস।
তিনি বলেন, ‘জমি দান করা হয়েছিল যাতে প্রতিদিন এক বিঘে জমির ফসল নিয়ে তৈরি করা হয় প্রভুর অন্নভোগ। যে ভোগ মন্দিরে আগত সকলকে প্রসাদ হিসেবে খাওয়ানো হতো।’
তারপরে সুবর্ণরেখা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বারবার কাঠের রথ ভেঙে পড়ার কারণে এখন লোহার রথ বানানো হয়েছে। তবে এখনও আগের মতো রথের উৎসবের উচ্ছ্বাস রয়েছে। এখনও প্রদীপ দাসের বাড়ি জগন্নাথের মাসির বাড়ি। উল্টো রথের দিন জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা বেরোলেও আগের মতো থেকে যান মুদিগেড়িয়াতে। ফেরেন না মন্দিরে। কেন?
শুভাশিসের কথায়, ‘যে টুকু বাবার কাছ থেকে শুনেছি, তৎকালীন সময়ে মুদিগেড়িয়াতে নাকি কোনও অনুষ্ঠান হতো না। তখন মুদিগেড়িয়ার বাসিন্দারা অনুরোধ করেন, যদি জগন্নাথদেবের সঙ্গে বছরে একটি দিন উৎসবে মুখরিত হতে পারেন ওই এলাকার মানুষ। তারপর থেকেই সেই প্রথা আজও চলে আসছে।’