মিঠুন ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি
কখনও তীর বোমাবর্ষণের আওয়াজ। কখনও আবার মাটিতে মিসাইল আছড়ে পড়লে কেঁপে উঠছিল ঘর। ইরান-ইজরায়েলের যুদ্ধ পরিস্থিতি আতঙ্কিত করে তুলেছিল সেখানকার বাসিন্দাদের। ফলে গবেষণার কাজ ফেলে রেখে বাড়ি ফিরতে হলো শিলিগুড়ির মধ্য শান্তিনগরের এক তরুণকে।
বাড়িতে তাঁর মা ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন প্রবাসে তরুণের নিরাপত্তা নিয়ে। নিরাপদে ফিরে এলেও আবার গবেষণায় যোগ দিতে মুখিয়ে আছেন শিবম দে।
শহর সংলগ্ন ডাবগ্রাম-২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় বাড়ি গবেষকের। বৃহস্পতিবার দুপুরে বাবা-মা ও মামার পাশে বসে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিলেন তিনি। ছোট থেকেই পড়াশোনায় মেধাবী শিবম গবেষনার সুযোগ পেয়েছিলেন ইজরায়েলে।
চলতি বছরের মার্চে সেখানকার হিরু বিশ্ববিদ্যালয়ে যান গবেষণার কাজে যোগ দিতে। ভালোই চলছিল পড়াশোনা, গবেষণার কাজ। এরই মধ্যে ইজরায়েল সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ইরানের সঙ্গে। আকাশপথে লড়াই শুরুনা সঙ্গে সঙ্গে রাতের ঘুম প্রায় উবে গিয়েছিল প্রাচীর শহর জেরুসালেমের বাসিন্দাদের।
প্রবাসী বলে বছর ২৬-এর শিবমদের উদ্বেগ ছিল একটু বেশিই। বলেন, ‘যখন-তখন সাইরেন বেজে উঠছে। তার মানেই বিপদ আসন্ন। সকলকে বাঙ্কার বা শেল্টারে ঢুকে পড়তে হতো। সে জন্য দূরে যেতে হতো না। এখানকার সব ভবন ও জনবসতি এলাকায় বাঙ্কার থাকে। সেখানে ঢুকে পড়তাম ইরানি হামলার ভয়ে।’
ইজরায়েলকে এই সংঘর্ষে ভালোই জবাব দিয়েছে ইরান। ফলে জেরুসালেমে শিবমদের প্রতিটা মুহূর্ত কেটেছে আশঙ্কায়। তরুণ গবেষক বলেন, ‘আশপাশের এলাকায় আছড়ে পড়ত মিসাইল। মাটি কেঁপে উঠত। বাড়ি যেন দুলে উঠত। বুঝতে পারতাম, ইরান দূরে কোথাও মিসাইল হানা চালিয়েছে।’
দূরে কোথাও যখন ছেলের অবস্থা এমন, বাড়িতে কী অবস্থা ছিল বাবা-মায়ের। যখন-তখন সাইরেন বেজে উঠছে। মানেই বিপদ আসন্ন। বাঙ্কার বা শেল্টারে ঢুকে পড়তে হতো। সব জনবসতি এলাকায় বাঙ্কার থাকে।
সেখানে ঢুকে পড়তাম ইরানি হামলার ভয়ে শিবম দে, প্রবাসী গবেষক শিবমের বাবা অসম রাইফেলসের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী সমর দে। তিনি অবশ্য খুব একটা বিচলিত ছিলেন না। কিন্তু ছেলের জন্য উৎকণ্ঠায় দিন কেটেছে মায়ের।
শিবমের মা ঝর্না বলেন, 'দিনরাত খবরে দেখছিলাম, ইজরায়েলে ইরান লাগাতার আক্রমণ করছে। টিভি দেখলেই আমার টেনশন হতো। সর্বক্ষণ কী হয় কী হয়, এমন একটা ব্যাপার। আত্মীয়-স্বজনরাও ছেলের বিদেশে থাকা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।'
বাড়ি থেকে অভিভাবকরা বারবার বলছিলেন, শিবম যেন দেশে ফিরে আসেন। দিন কয়েক আগে শিবম ইজরায়েলে থাকা ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। দেশে ফিরে আসতে চাইলে দূতাবাস থেকে শিবমকে ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
গত সোমবার জেরুসালেম থেকে বিমানে দিল্লির উদ্দেশে রওনা হন শিবম। জর্ডন হয়ে গত মঙ্গলবার দিল্লি এসে পৌঁছন। সে দিন দিল্লিতে হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে বুধবার বিমান ধরে পৌঁছন বাগডোগরা বিমানবন্দরে। সেখান থেকে বাড়িতে।
শিলিগুড়িতে পড়াশোনার পরে ওড়িশার ভুবনেশ্বরে অবস্থিত কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজি থেকে বিটেক এবং এমটেক করেন শিবম। এর পরে গবেষণার সুযোগ পান আইআইটি গুয়াহাটিতে।
সেখানে গবেষণারত অবস্থাতেই সুযোগ মেলে জেরুসালেম যাওয়ার। এই সুযোগ পেয়ে দু’বার ভাবেননি তরুণ। মাস তিনেক আগে রওনা দেন বিদেশে। শিবম জানান, তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, সেটি ইজরায়েলের শীর্ষস্থানীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা শতাব্দীপ্রাচীন। তাই আবার জেরুসালেম ফিরে যেতে চান শিবম।
পরিস্থিতি এখন ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে। সংঘর্ষ বিরতির ফলে স্বস্তি পেয়েছে দু’দেশের মানুষ। একই স্বস্তি শিলিগুড়ির মধ্য শান্তিনগরের বাড়িতে। ছেলে ঘরে ফিরেছে নিরাপদে। শিবম বলেন, ‘গবেষণার স্বপ্ন তো অসম্পূর্ণ রাখা যায় না। তাই পরিস্থিতি বুঝে ফিরে যেতে চাই।’