রাতের ট্রেনে চেপে রতন কালু আর সমীরনরা কলকাতা যাচ্ছে। কাল চিৎপুরে রথযাত্রা। তাই আগের দিন রাতে ট্রেনে চেপে কেউ পুরুলিয়া থেকে, কেউ বাঁকুড়া ,আবার কেউ আসানসোল থেকে কলকাতার পথে। ওরা চলেছে যাত্রার দল বায়না করতে। সকালবেলা গিয়ে যাত্রা দলের অফিসের দরজায় লাইন দেবে। কিন্তু চিৎপুরে পৌঁছে ওরা সবাই হতবাক। সব যাত্রা দলের অফিসের সামনেই যে লম্বা লাইন। এত সকালে এত লোক! পাশ থেকে লাইনে দাঁড়ানো এক ছোকরার দল চিৎকার করে উঠলো, “ও দাদা পেছনে লাইনে দাঁড়ান”। আর একদল বলে উঠলো “আমরা কাল রাত থেকে লাইনে আছি!” ওদের সবার পছন্দের শিল্পীদের ওরা বায়না করবে, আর সেই পছন্দের তালিকায় এক ঝাঁক স্টার শিল্পী। স্বপন কুমার ,স্বপ্না কুমারী, ইন্দ্র লাহিড়ী, ছন্দা চ্যাটার্জি, জ্যোৎস্না দত্ত, গুরুদাস ধাড়া, মোহন চ্যাটার্জি, মিতা চ্যাটার্জি, দিলীপ কুমার, মধুশ্রী দেবী, বেলা সরকার, দেব গোপাল, বীণা দাশগুপ্তা, অরুণ দাশগুপ্ত, রাজা ভট্টাচার্য, শিবানী ভট্টাচার্য, এছাড়াও অশোক কুমার, শেখর গাঙ্গুলী, দিলীপ চ্যাটার্জি, তপন ভট্টাচার্য, তপন গাঙ্গুলী, শিবদাস মুখার্জি, অরুণ মুখার্জি, অনাদি চক্রবর্তী, রুমা দাশগুপ্ত, তরুণ কুমার, ললিতা চ্যাটার্জি রাজেশ ভট্টাচার্য, নিরঞ্জন ঘোষ, শান্তিগোপাল— এঁরা সবাই স্বমহিমায় এককভাবে মাঠের তারা। শুধু অভিনেতা অভিনেত্রীদের জন্য এমন উন্মাদনা ছিল তা নয়। পালাকারদেরও ম্যাচ করিয়ে নিতেন যাত্রা কমিটিরা। কারুর পছন্দ ঐতিহাসিক পালা। কারোর ভক্তিমূলক।
কারোর আবার সামাজিক পালা। কেউ বাছছেন ব্রজেন্দ্রকুমার দে, কেউ ভৈরববাবু, কেউ কেউ উৎপল দত্ত, প্রসাদকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, সুনীল চৌধুরী, জ্যোতির্ময় দে বিশ্বাস, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দময় বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্ভু বাগ, নির্মল মুখোপাধ্যায়, তপন গাঙ্গুলী, স্বপন সেনগুপ্ত, সমীর মজুমদার, অসিত বসু, শৈলেশ গুহ নিয়োগীদের। এছাড়াও সিনেমা জগতের শিল্পীরাও তখন পছন্দের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। বসন্ত চৌধুরী, সন্তু মুখোপাধ্যায়, পাপিয়া অধিকারী, রবি ঘোষ, দীপঙ্কর দে, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্ময় রায়, শ্রীলা মজুমদার, দেবরাজ রায়, তরুণ কুমাররা তখন মাঠেরও তারা। সুরকাররাও তাদের যাত্রার টান উপেক্ষা করতে পারেননি। পদ্মশ্রী মান্না দে, দুর্গা সেন, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্ত ভট্টাচার্য, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, স্বপন পাকড়াশি, এক কথায় চিৎপুর যাত্রা পালা তখন চাঁদের হাট। মনে রাখবেন, এসব সত্তরের দশক থেকে আশির দশকের শেষের গল্প। ৯০-এর দশকের সময় থেকেই চিৎপুর যাত্রা জগতের মধ্য গগনের সূর্য পশ্চিম আকাশের দিকে ঢলে পড়তে লাগলো। যাত্রা সংস্কৃতির এই ভাটার টানের উল্টো দিকে যাত্রা তরণীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার হাল ধরতে অনেক প্রতিভা উঠে এলেন। শক্ত হাতে হাল ধরে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অদম্য চেষ্টার মধ্যে কোনও ক্লান্তি আজও নেই। এখন শুধু জোয়ারের প্রতীক্ষা। সেই জোয়ারে যাত্রা বৈতরণী তার পথ বদল করবে কিনা তা ভবিষ্যৎ বলবে। (অনল চক্রবর্তী একজন বিখ্যাত যাত্রা অভিনেতা। তিনি এবং কাকলি চৌধুরী যাত্রা জগতের অত্যন্ত জনপ্রিয় জুটি।)