• রথযাত্রা ও যাত্রাশিল্পের সম্পর্ক
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২৭ জুন ২০২৫
  • দেবপ্রিয় বাগচী

    রথের দিন থেকেই কলকাতার যাত্রাপাড়া চিৎপুরে যাত্রাপালার বুকিং শুরুর রেওয়াজ বহু যুগ ধরেই। উত্তর কলকাতার চিৎপুরে প্রতিটি যাত্রা কোম্পানির গদিঘরকে রথের দিন সাজানো হতো ফুল দিয়ে। বাজতো সানাইয়ের সুর। একটা সময় ছিল যখন সকাল থেকেই রথের দিন নতুন যাত্রাপালা বুকিংয়ের জন্য লেগে থাকতো জমজমাট ভিড়। যাঁরা পালা বুকিং করতে আসতেন তাঁদের জন্য থাকতো ভোজনের ব্যবস্থাও। আবার মিষ্টি পান মুখে পুরে বাড়ির জন্য যাত্রা সংস্থা থেকে নিয়ে যেতেন মিষ্টির প্যাকেটও। দুর্গাপূজো, কালীপুজো থেকে শীতকালে ধান ওঠার সময় গ্রামবাংলায় যাত্রাপালা শোয়ের জন্য অগ্রিম বুকিংয়ের শুভ দিন ছিল রথযাত্রার পুন্য তিথি। কিন্তু কালের নিয়মে তাতে ভাতা পড়লেও এই শুভ দিনটিতে যাত্রাশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই সরকারই গড়েছেন পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমি।

    বাংলার যাত্রাশিল্পের ইতিবৃত্ত

    বাংলার যাত্রাশিল্প ইতিবৃত্ত জানতে হলে আমাদের অবশ্যই অতীতে ফিরে যেতে হয়। বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তক মাধ্যম শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) অনুভব করেছিলেন, বক্তৃতা করে বাংলার মানুষকে যা বোঝানো যাবে না, একবার যাত্রাভিনয় করে তা মানুষের মনে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।

    সাড়ে চার শ’ বছর আগে শ্রীগৌরাঙ্গ যাত্রাশিল্পকে গৌরবান্বিত করেছিলেন তা দেখতে হলে তার ইতিহাস তুলে ধরা প্রয়োজন। শ্রীগৌরাঙ্গের বয়স মাত্র ১৪ বছর সে সময় বডু-চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করেন, সময়টা ছিল ১৫০০ সালের দিকে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের প্রভাবে শ্রীগৌরাঙ্গ তার গীতাভিনয়ে নিজস্ব অভিনয়পদ্ধতি সৃষ্টি করেছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও তিনি সংস্কৃত নাটকের ধ্রুপদ অভিনয়-পদ্ধতি গ্রহণ করেননি। চারদিকে দর্শক-শ্রোতা, মাঝখানে আসরে নৃত্য, গীত ও কথার মাধ্যমে তিনি ব্রজলীলা, রাবণবধ প্রভৃতি পালা পরিবেশন করেছেন। শোভাযাত্রা তিনি তার সহচরদের নিয়ে নেচে-গেয়ে কৃষ্ণলীলা প্রদর্শন করেছিলেন।

    সত্যি কথা বলতে, যাত্রাগানের বিকাশ শুরু হয় ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। যাত্রাপালা উৎপত্তি থিয়েটার বা নাটকের আগে। নাটকের আগেই যাত্রার বিকাশ ঘটে। এ কারণে যাত্রার ঐতিহ্যকে প্রথমেই তুলে ধরতে হয়। যাত্রাশিল্প সুকুমারকলার মর্যাদায় অভিষিক্ত ছিল। ষোড়শ শতকে শ্রীগৌরাঙ্গের প্রভাবে জন্ম নেওয়া কৃষ্ণযাত্রাই অধিকতর স্থায়ী এবং জনপ্রিয় হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের কেঁদুলি গ্রামের অধিবাসী শিশুরাম অধিকারী ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কৃষ্ণযাত্রাকে শিল্পসম্মতভাবে পরিবেশন করে সুখ্যাত হন।

    তিনি ‘কালীয়দমনযাত্রা’র প্রবর্তন করেন, যা পরিবর্তীকালে ‘কৃষ্ণযাত্রা’ নামে জনপ্রিয় হয়। কৃষ্ণযাত্রার পালাগুলোর মধ্যে কলঙ্কভঞ্জন, মানভঞ্জন, নৌকাবিহার, গোষ্ঠবিহার সুবলমিলন, যোগীমিলন, প্রভাসমিলন, মুক্তলতাবলী, কৃষ্ণকালী, ননীচুরি প্রভৃতি ছিল উল্লেখযোগ্য। এই পালাগুলো বিশেষভাবে দর্শকনন্দিত হয়েছিল।

    প্রসঙ্গত, ১৮ শতকের শেষভাগে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের (১৭১২-১৭৬০) ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের কাহিনি অবলম্বনে রচিত বিদ্যাসুন্দর যাত্রা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ওই সময় গ্রামের নিরক্ষর আর অল্পশিক্ষিতদের পক্ষে ইংরেজদের প্রচলিত থিয়েটারের প্রতি আসক্তি ছিল না নানা কারণে। গ্রামগঞ্জে থিয়েটার করা ব্যয়সাধ্য ছিল। রাস্তাঘাট ছিল না, ছিল না পয়সাকড়ি, ছিল না থিয়েটারের কাহিনি বোঝার ক্ষমতা। এ কারণেই ধর্মবিষয়ক কৃষ্ণযাত্রা ও রামযাত্রা দেখার আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে সাধারণ জনগণের মাঝে। সেটা ছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি। ইংরেজের প্রবর্তিত থিয়েটারের হাত থেকে যাত্রার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসেন সে সময়ের যাত্রার অন্যতম অধিকারী কৃষ্ণকমল গোস্বামীসহ অনেকেই। কৃষ্ণকমল গোস্বামী ১৮৬০ সালে তার রচিত স্বপ্নবিলাস ও দিব্যোন্মাদ পালার মাধ্যমে যাত্রাশিল্পে প্রাণ সঞ্চার করেন। তিনি বর্তমানের বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে তার পালাগুলো পরিবেশন করে প্রশংসা লাভ করেন।

    যাত্রাশিল্পের বিপন্নতা

    নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলার যাত্রাপালার কদর কমতে থাকে। তার একটা কারণ, ততদিনে টিভি পৌঁছে গেছে ঘরে ঘরে। নানান ধরনের সিরিয়াল এবং বম্বে ফিল্মের প্রভাব টিভির মাধ্যমে পড়ছে সাধারণ মানুষের মনে। ঘরে বসেই তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন শাহরুখ খান, কাজল, সলমন খান, ক্যাটরিনা কাইফ, ঋত্বিক রোশন, প্রিয়াংকা চোপড়াদের। এই জৌলুসের কাছে যাত্রাপালা ক্রমশই ম্লান হয়ে উঠল সাধারণ মানুষের কাছে। এমনকি গ্রামাঞ্চলেও। তাছাড়া টেনে রাখার মতো গল্প, অভিনয়ের ক্ষেত্রেও যেন কিছুটা ভাটার টান। তারপর এল মোবাইল ফোনের যুগ। তারপর তো হাতের মুঠোর মধ্যেই চলে বিশ্বের তাবৎ ঝলমলে পণ্যসংস্কৃতি। উন্মুক্ত নারীদেহ থেকে আইপিএল ক্রিকেট— এসবে মজে গেল শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামও। এর ফলে ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে উঠতে থাকল যাত্রাশিল্পের দাপুটে ধারাটি।

    বাংলার জল-মাটির আপন ঐতিহ্যে গড়া যে বিনোদন শিল্প, সেই যাত্রা নিয়ে কয়েক দশক ধরে গবেষণা করেছিলেন প্রভাত দাস। যাত্রাশিল্প বাঁচবে কিনা সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘কী করে বাঁচবে! অন্ধকার রাতে বিশাল প্যান্ডেলের মধ্যে শয়ে শয়ে মানুষকে বসিয়ে রাখার মত গল্প কোথায়? মন মাতানো গল্প লেখার লোক কোথায়? একদা তেমন শক্তিশালী কলম নিয়ে ময়দানে এসেছিলেন ব্রজেন্দ্রকুমার দে। তাঁর উত্তরসূরি যদি কেউ হন, তিনি ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়। তারপর? না, তেমন শক্তিশালী আর কেউ এলেন না। যাঁরা এলেন তাঁরা উপহার দিলেন কিছু নাচ-গান, হইহুল্লোড়। ব্যস, ওই দিয়েই ভাবলেন, বেশ সমসাময়িক করে তোলা গেল যাত্রাকে। ঘণ্টা! মানুষ শুনতে চায় গল্প। চরিত্র কিংবা আদর্শের সংঘাত। কেবল কিছু মানুষের স্টেজে হাঁটাচলা দিয়ে কিস্যু হবে না।’

    ঘুরে দাঁড়াচ্ছে যাত্রাশিল্প

    ঘরে ঘরে টিভি আর হাতে হাতে মোবাইলের সস্তা এবং সহজ বিনোদনের প্রভাবে কৌলিন্য হারিয়ে ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে প্রায় বিলুপ্তপ্রায় শিল্পে পরিণত হয়েছিল বাংলার যাত্রাশিল্প। আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে করোনা মহামারির প্রভাবে। মনে হয়েছিল যাত্রাশিল্প বুঝি নির্বাসনে গেল। তবে এ বিষয়ে আপাতত আর হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আবার ক্ল্যারিওনেট, কর্নেট, ফ্লুটের সমবেত কনসার্টে ইদানিং জেগে থাকে শীতের রাত ও গ্রাম বাংলা। আবার যাত্রাপালার আসর বসতে দেখা যায় শহরে, গ্রামে। আশা জাগছে, প্রিয় শিল্পীদের অভিনয় দেখার জন্য মানুষও ভিড় জমাবেন যাত্রার আসরে। যাত্রাশিল্পে নবজোয়ার আসার সুখবর দিচ্ছেন যাত্রার কলাকুশলী থেকে শুরু করে যাত্রাদলের ম্যানেজার, গদিঘরের কর্ণধার সকলেই। বাংলা লোকসংস্কৃতির প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বিনোদন মাধ্যমগুলির অন্যতম হল এই যাত্রাপালা। মেদিনীপুরের মানুষ সংস্কৃতিমান। চিরায়ত সংস্কৃতির পীঠস্থান এই অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় (পূর্ব, পশ্চিম ও ঝাড়গ্রাম) স্বাভাবিকভাবে ঠাঁই পেয়েছে যাত্রা, নাটক, থিয়েটারও। বর্তমানে যাত্রার একটা বৃহত্তম বাজার তৈরি হয়েছে এই জেলায়।নন্দকুমার ও বেলদাকে বলা হয় ‘মেদিনীপুরের চিৎপুর’।

    কিন্তু চটুল এবং সস্তার সংস্কৃতির বৃদ্ধিতে যাত্রা সংস্কৃতির নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করে যাত্রাশিল্পের। স্তিমিত হতে থাকে যাত্রা নিয়ে জনমানসে তৈরি হওয়া আঞ্চলিক ক্লাব, গ্রাম কমিটি, বিদ্যালয় কিংবা কোনও প্রতিষ্ঠান তাদের মেলা উৎসবে যাত্রাশিল্প থেকে মুখ ফেরানোয় হতাশাজনক হয়ে ওঠে যাত্রাশিল্পকে ঘিরে তৈরি হওয়া অন্নসংস্থানের পথও। তবুও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বুকিং এজেন্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এখন অনেক বেশি যাত্রার বুকিং বেড়েছে। তাঁদের কথায়, বিলুপ্তপ্রায় যাত্রাকে ফিরিয়ে আনার নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে। যাত্রা দলগুলির তরফেও বদল আনা হয়েছে নানা ভাবনায়। বর্তমান টিভি ধারাবাহিকের যুগে যাত্রার কাহিনী নির্মাণে পৌরাণিক, ঐতিহাসিকের পরিবর্তে সামাজিক এবং রাজনৈতিক পটভূমির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে বিশেষ ভাবে। তেমনই জোর দেওয়া হচ্ছে বর্তমান যুগোপযোগী অভিনয়ের ধারায়। আর তার প্রভাবেই নবযাত্রা শুরু হয়েছে বাংলার যাত্রাপালার। যাত্রাশিল্পীরা বলছেন, ‘যাত্রাপালাকে মাঠমুখী করে তুলতে বর্তমান সরকারের ভূমিকা অপরিসীম। দুঃস্থ ও বয়স্ক যাত্রাশিল্পীদের অনুদান, যাত্রাদলের উন্নয়ন থেকে শুরু করে সরকারি নানা মেলা, অনুষ্ঠানে যাত্রাকে প্রাধান্য দিয়েছে রাজ্যের সরকার। তাছাড়া যুগোপযোগী কাহিনী নির্মাণ ও অভিনয়ে জোর দিচ্ছি আমরা। তাতেই জনমানসে যাত্রা নিয়ে নতুন উন্মাদনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যাত্রা শিল্পে সত্যি সত্যি নতুন জোয়ার এসেছে।’ সময়ের ধারায় যাত্রাও এখন আরও আধুনিক এবং স্মার্ট। এখন যাত্রার বায়না বেশ ভাল। নতুন দলের সংখ্যাও বেড়েছে। পুরোনোরা তো আছেনই, নতুন নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও আসছেন যাত্রায়। নতুন আঙ্গিকের পালা তৈরি হচ্ছে। ফলে যাত্রার প্রতি আবারও মানুষের ঝোঁক বাড়ছে। ভাল বায়না হচ্ছে। এরকম জানাচ্ছেন বিভিন্ন যাত্রাপালার সঙ্গে জড়িত লোকজন।

    দুই মেদিনীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে ছাড়িয়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বহু ক্লাব, সংস্থা তাঁদের দুর্গাপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো, কালীপুজো, বাসন্তীপুজোয় যাত্রাপালার উদ্যোগ নিচ্ছে। ‘অন্যান্য বছরে আমরা দুর্গাপুজোর আগে আগে বুকিং কাউন্টার খুলতাম। এবার রথের দিন থেকেই শুরু করি। বায়না চলে রথের দিন থেকেই।’

    রাজ্য সরকারের ভূমিকা

    দুঃস্থ যাত্রাশিল্পীদের সসম্মানে বাঁচার জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা করা হয়ে থাকে। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া যাত্রা শিল্পীদের মাথা পিছু ভাতা চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। যাত্রাশিল্পীদের একাকালীন সাহায্যের পরিমান ৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫ টহাজার টাকা করা হয়েছে। বাংলার লোকসংস্কৃতির অঙ্গ যাত্রাপালার মধ্যে দিয়ে উঠে আসে দেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বাস্তব অবস্থার কথা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময়ই বলেন, যাত্রাপালার মাধ্যমে বাংলার সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থাকে আরও বেশি করে তুলে ধরা দরকার।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)