• মনোজিতের গ্যাং ছাড়েনি ‘রাত দখলের’ পড়ুয়াদেরও, আগেও বহু নালিশ!
    এই সময় | ২৮ জুন ২০২৫
  • গত বছর আরজি কর আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল ১৪ অগস্ট রাতে ‘রাত দখল’–এর কর্মসূচি থেকে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মতো দক্ষিণ কলকাতার একটি আইন কলেজ থেকেও বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী ওই কর্মসূচিতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেসবুক লাইভও করেছিলেন।

    সেই পড়ুয়াদের অনেকেই শুক্রবার বলছেন, মনোজিৎ মিশ্র এবং তাঁর দলবল তখন ফেসবুক ধরে তালিকা বানিয়েছিলেন কারা সেই রাত দখলের আন্দোলনে গিয়েছিলেন। তারপরে তাঁদের ফোন করে কলেজে ডেকে পাঠান মনোজিৎ।

    রাত দখলে অংশ নেওয়ার জন্য হুমকি, এমনকী মারধরও চলে বলে অভিযোগ। এক ছাত্র প্রতিবাদ করায় তাঁকে লেক মলের সামনে থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মনোজিতের অনুগামীদের বেধড়ক মারের জেরে তাঁকে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।

    এই সব ঘটনায় অপহরণ, মারধর-সহ আরও নানা ধারায় মামলা দায়ের হয় মনোজিৎদের দলবলের নামে। কিন্তু তাঁর কেশাগ্র ছুঁতে পারেনি পুলিশ।

    দক্ষিণ কলকাতার আইন কলেজের ক্যাম্পাসের মধ্যে গণধর্ষণে অভিযুক্ত মনোজিৎ গ্রেপ্তার হওয়ার পরে পুরোনো এই সব অভিযোগ নতুন করে সামনে এসেছে। অভিযোগ, ওই কলেজ ক্যাম্পাসে মনোজিৎ এতটাই প্রভাবশালী যে, তাঁর মুখের উপরে কথা বলতে পারতেন না কলেজের স্যর-ম্যাডামরাও।

    মনোজিতের হাতে মার খেকে অচৈতন্য হয়ে পড়া ওই ছাত্র এ দিন বলেন, ‘আমরা অন্তত ১০-১২ জন ছাত্রছাত্রী এমন আছি, যাঁরা ওঁর ভয়ে গত এক বছর ধরে ক্যাম্পাসেই ঢুকতে পারি না। আমাদের অপরাধ, কেন আমরা রাত দখলের আন্দোলনে গিয়েছিলাম!’

    শুধু রাত দখল কর্মসূচি নয়, কলেজে মনোজিতের বিরুদ্ধে কোনও কথা বললেই ক্যাম্পাসে, এমনকী ক্যাম্পাসের বাইরে মারধর করে মনোজিৎ ওই ছাত্রছাত্রীদের কলেজ–ছাড়া করতেন বলে অভিযোগ।

    সূত্রের দাবি, পুলিশের খাতায় অন্তত ২০টি মামলা রয়েছে মনোজিতের নামে। ২০১৭ সালে কলেজে ভাঙচুর চালানো, তারপরে ক্যাম্পাসে সিসিটিভি ভাঙচুরের ঘটনাতেও নাম জড়িয়েছে মনোজিতের।

    প্রয়াত প্রিন্সিপাল দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৭ সালে মনোজিৎকে ক্যাম্পাসে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগে একবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অন্তত তিনবার মনোজিৎকে সাসপেন্ড করেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাঁকে বাগে আনা যায়নি কখনওই।

    কলেজ সূত্রে খবর, ২০১৪ সালে মনোজিৎ ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করতে ঢোকেন। কিন্তু পাশ করতে না পারায় ডিসকলেজিয়েট হয়ে যান। প্রথম থেকেই ক্যাম্পাসে টিএমসিপি–র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছিলেন ইউনিট প্রেসিডেন্টও। পরে ২০২১–এ দক্ষিণ কলকাতার সাংগঠনিক সম্পাদকও করা হয় তাঁকে।

    যদিও টিএমসিপি–র রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যের দাবি, সংগঠনের কোনও পদে ছিলেন না মনোজিৎ। কলেজের অনেকেই বলছেন, ‘প্রভাব খাটিয়ে’ মনোজিৎ আবার ছাত্র হিসেবে ঢুকে পড়েন কলেজে।

    বছর তিনেক আগে শেষ পর্যন্ত পাশ করলেও কলেজ ছেড়ে যাননি তিনি। তাঁকে নিয়ে বার বার অভিযোগ দায়ের হয়েছে কর্তৃপক্ষের কাছে। অভিযোগকারীরা মার খেয়েছেন, তবে কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি বলে অভিযোগ।

    কালীঘাট অঞ্চলেই বাবার সঙ্গে থাকেন মনোজিৎ। এলাকা সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁর মা ও বোন মনোজিৎ ও তাঁর বাবার সঙ্গে থাকেন না। বাবা অবশ্য বলছেন, ‘আমার ছেলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার করা হয়ে থাকতে পারে।’ এলাকায় অনেকেই মনোজিৎ–কে ‘ম্যাঙ্গো’ নামে চেনেন।

    কলেজের এক ছাত্রের কথায়, ‘আমরা বহুবার মনোজিতের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে মার খেয়েছি। কলেজ–ছাড়া হয়েছি। ২০২৪ সালে যখন ওকে কলেজের ক্যাজ়ুয়াল স্টাফ হিসেবে নেওয়া হবে শুনেছিলাম তখনও আমরা আপত্তি তুলেছি। কাজ হয়নি। কয়েকজন ছাত্রীও অভিযোগ করেছিলেন। তাঁদের বাড়ি, মেসের সামনে গুন্ডা পাঠিয়ে ভয় দেখিয়েছে মনোজিৎ।’

    কী করে মনোজিৎ ওই কলেজে চাকরি পেলেন? প্রশ্নের মুখে ভাইস প্রিন্সিপাল নয়না চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘যা হয়েছে, সব কলেজ পরিচালন সমিতির রেজ়োলিউশন করে হয়েছে। আমার কাছে সেই সব ডকুমেন্ট রয়েছে।’

    কলেজে মনোজিতের ‘দু’হাত’ বলে পরিচিত ছিলেন গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত আরও দু’জন প্রমিত মুখোপাধ্যায় এবং জ়ইব আহমেদ। প্রমিত কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। থাকেন হাওড়ায়। আর জ়ইব প্রথম বর্ষের ছাত্র, বাড়ি তিলজ‍লায়।

    মূলত এই দু’জনকে দিয়েই কলেজে ‘রাজ’ করতেন ম‍নোজিৎ। অভিযোগ, ধর্ষণের সময়েও জ়ইব আর প্রমিতই ঘর আটকে পাহারা দিয়েছিলেন। কলেজে নেশার আসর হোক বা টাকা নিয়ে ভর্তি, ফেস্টের নামে অশালীন ফূর্তি— সবেতেই কমন এই তিনটি নাম, এমনই দাবি অনেক পড়ুয়ার।

  • Link to this news (এই সময়)