• প্রাক্তনীর দাপটে মেরুদণ্ড নত বহু কলেজেই
    আনন্দবাজার | ২৮ জুন ২০২৫
  • তাঁরা শাসক দলের ছাত্রনেতা। কলেজের সঙ্গে সম্পর্কটা তাই ‘আজন্মের বন্ধন’ বলেই রসিকতা চলে সংশ্লিষ্ট মহলে। উত্তর কলকাতার একটি পুরনো কলেজে জনৈক শিক্ষাকর্মী বাম আমলে শাসক দলের ছাত্রনেতা ছিলেন। তৃণমূল জমানাতেও শাসক দলের ছাত্রনেতা হয়ে ওঠেন তিনি। পরে তিনিই কলেজের কর্মচারীও হয়েছেন। কসবার আইন কলেজের একদা দাপুটে ছাত্রনেতা তথা এখনকার শিক্ষাকর্মী ‘এম’-এর বিরুদ্ধে ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে আসার পরে রাজ্য জুড়েই কলেজে কলেজে প্রভাবশালী প্রাক্তনীদের নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে।

    চলতি রাজনৈতিক জমানায় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে অপরাধের যোগ ক্রমশ বেড়েছে বলেই মনে করছেন দক্ষিণ কলকাতার একটি পরিচিত কলেজের অধ্যাপিকা। তাঁর কথায়, “২০১৭-র পরে কলেজে ইউনিয়ন নির্বাচন বন্ধ। কোনও ছাত্র প্রতিনিধি না-থাকায় প্রাক্তনীদের দাপট আরও বেড়েছে।” দু’বছর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলে র‌্যাগিংয়ে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনাতেও প্রাক্তনীদের নাম উঠে আসে। ইউজিসি-র বিধি মেনে এর পরে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রদের জন্য শিক্ষাঙ্গনের ভিতরেই আলাদা হস্টেলের বন্দোবস্ত হয়েছে। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কলেজে ‘প্রাক্তনী-রাজ সংস্কৃতি’ ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠছে তার পরেও।

    ইউনিয়ন না-থাকলেও অনেক কলেজে স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার কমিটির নামে ছাত্রনেতা তথা শাসক দলের ছাত্র সংগঠনেরই রাজত্ব চলে বলে অভিযোগ। কলেজের নানা অনুষ্ঠান সামলায় ওই কমিটিই। ভর্তির অনলাইন পোর্টাল চালু হলেও গত বছরও কলেজের অনেক আসন ফাঁকা থাকায় পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ সরাসরি ভর্তি প্রক্রিয়ায় নামেন। তখন ছাত্রনেতা কিংবা ‘কীর্তিমান’ প্রাক্তনীদের একাংশের পোয়া বারো দেখা যায় বলে অভিযোগ। উত্তর কলকাতার একটি কলেজের অধ্যাপিকা বলেন, “কোনও কোনও ছাত্রনেতা আবার বছরের পর বছর পাশ করারই চেষ্টা করে না। কোভিডের সময়ে পাশ করানোর উদার হওয়ায় নিরুপায় হয়ে পাশ করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু কলেজে তাদের দাপট কমেনি।”

    উত্তর কলকাতার একটি পুরনো কলেজে আবার অধ্যক্ষ হস্টেল মেরামতির কিছু কাজ সরাসরি পূর্ত দফতর মারফত করানোয় প্রাক্তনী তথা ছাত্রনেতাদের রোষের মুখে পড়েন। কলেজ কর্তৃপক্ষ নিজেরা দরপত্র না ডাকায় ওই ছাত্রনেতারা প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাননি বলে অভিযোগ। এর পরে কলেজে ওই কাজ বন্ধ করানোর নানা অপচেষ্টা হয়েছিল বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর। দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী কলেজের বটানির অধ্যাপক তাঁর রাজনৈতিক মতামতের দরুন ছাত্রনেতাদের হাতে ‘মার’ খেয়ে দীর্ঘ দিন কলেজমুখো হন না বলে অভিযোগ। যোগেশচন্দ্র চৌধুরী কলেজের অধ্যক্ষ পঙ্কজকুমার রায়ের অভিযোগ, ‘‘কলেজে শেষ কয়েকটি গভর্নিং বডির সভায় ছাত্রনেতাদের উপস্থিতি বন্ধ করতে গিয়ে অপমানিত হতে হয়েছে। গত মে মাসে সভা শুরুর আগে কিছু ছাত্র অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করে। কোর্টের নির্দেশ থাকলেও কলেজ চত্বরে বহিরাগত প্রভাবশালী প্রাক্তনীদের উপস্থিতিও বন্ধ করা যায়নি।’’

    নৈশ কলেজ এবং ইউনিয়ন রুমে সন্ধ্যা হলে ছাত্রনেতাদের দাপাদাপিই নানা জায়গায় দস্তুর। ইউনিয়ন না-থাকলেও জোর করে ইউনিয়ন রুম খুলিয়ে শাসক দলের ছাত্রনেতারাই ঘাঁটি গেড়ে বসেন বলে অভিযোগ বহু শিক্ষকের। দক্ষিণ কলকাতার একটি কলেজের অধ্যক্ষের মতে, ‘‘কলেজে কলেজে নিরাপত্তার অডিট করানো উচিত বিকাশ ভবনের। সব কলেজে সিসি ক্যামেরা মোতায়েন ও ফুটেজ জরিপ, কত দূর হয়, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।’’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (কুটা) সাধারণ সম্পাদক তথা বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক সাগরময় ঘোষ বলছেন, ‘‘প্রশাসনের অকর্মণ্যতার ফলে বিভিন্ন কলেজে সিমেস্টারের ফর্ম-ফিলআপ থেকে নানা কাজে ছাত্রনেতা, প্রাক্তন ছাত্রনেতারা ছড়ি ঘোরায়।’’ কলেজের পরিস্থিতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নিস্পৃহতার দিকেও কুটা আঙুল তুলেছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায় বলেন, ‘‘ইউনিয়ন ভোট না হওয়া ছাড়াও আর জি করের ঘটনায় সুবিচার না-মেলাতেও এমন অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে।’’ ওয়েবকুপা, এআইডিএসও, আক্রান্ত আমরা-ও কলেজে দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে সরব।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)