• সোনার ঝাড়ু দিয়ে জগন্নাথের যাত্রাপথ ঝাঁট দিলেন মমতা
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২৮ জুন ২০২৫
  • সমুদ্রস্রোতের গর্জন, রঙিন আলোক এবং পুষ্পসজ্জা, কীর্তনের ছন্দ ও চন্দনের সুগন্ধ মিলে শুক্রবার এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হল দিঘা তথা গোটা বাংলা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলার সমুদ্রতটে এই প্রথম আয়োজিত হল প্রভু জগন্নাথদেবের মহারথযাত্রা। শাস্ত্রীয় রীতিনীতি মেনে মহাসাড়ম্বরে এবং বিপুল জনসমাগমের মধ্য দিয়ে উৎসবের জোয়ারে নতুন পরিচয়ে আবির্ভূত হল সমুদ্রশহর দিঘা, যার প্রতিটি অলিগলি কীর্তনের ছন্দে মুখর। শুক্রবার রথযাত্রা। পুরীর আদলেই জগন্নাথদেব, বলরাম এবং সুভদ্রার জন্য তিনটি আলাদা রথের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল দিঘার বুকেও। পূর্ব নির্ধারিত সূচি এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নির্দেশ মতো, বৃহস্পতিবার রাতেই রথগুলিকে মন্দিরের সামনে নিয়ে আসা হয়।

    শুক্রবার সকাল ন’টা থেকেই রথ সজ্জার প্রস্তুতি এবং মন্দিরে পূজাপাঠ শুরু হয়। মন্দিরের এক নম্বর গেটের বাইরে রাখা হয়েছিল সুসজ্জিত তিনটি রথ এবং দু’নম্বর গেট নিয়ে দর্শনার্থীদের মন্দিরের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে মন্দিরের ভিতরে সর্বসাধারণের জন্য প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। ঠিক দুপুর পৌনে দু’টো নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী পায়ে হেঁটে জগন্নাথধামের উদ্দেশে রওনা দেন। তার আগে সার্বিক নিরাপত্তার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে নিয়েছিলেন রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার। রথের নিকটে পৌঁছে দুপুর দু’টোর সময় মুখ্যমন্ত্রী তিনটি রথের সামনেই আরতি করেন ভক্তি ভরে।

    এরপর মুখ্যমন্ত্রী নিজের হাতে তুলে নেন তাঁরই উপহার দেওয়া সোনার ঝাড়ু, দেবতার যাত্রাপথ নিজেই ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করেন মমতা।
    এরপর ঘড়ির কাঁটা যখন ঠিক আড়াইটে, নির্ধারিত সময় মেনেই রথের রশিতে টান দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সে সময় ঝিরঝিরে বৃষ্টি, মাঝে-মধ্যে মেঘের গর্জন, কীর্তনে মুখরিত পরিবেশ, ঢাক-কাঁসরের শব্দ এবং চারিদিকে উড়ছে রঙিন পতাকা। বৃষ্টিস্নাত উৎসবে দেবত্রয়ীর রথে অধিষ্ঠিত নিমকাঠের জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা যথাক্রমে ‘নন্দীঘোষ’, ‘তালধ্বজ’ ও ‘দর্পদলন’ ‘পাহান্ডি বিজয়’-এর মধ্য দিয়ে রওনা দিলেন তাঁদের মাসির বাড়ির উদ্দেশে। উল্লেখ্য, এই সন্ধিক্ষণে খোল-করতাল বাজিয়ে এবং কৃষ্ণ নামের মধ্য দিয়ে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার কাঠের মূর্তি রথে তোলা হয়। এই সময় খোল-করতাল হাতে, প্রভুর যাত্রাপথে পায়ে পা মিলিয়ে নাচের মাধ্যমে আরাধনায় সামিল হন ভক্তরা। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, রথ মানেই বৃষ্টি। ব্যতিক্রম হল না দিঘার এই ঐতিহাসিক মুহূর্তেও।

    বৃষ্টির মধ্যেই দিঘায় জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রার রথে রশি বাঁধা হয়। পাট এবং নারকেল ছোবড়া দিয়ে তৈরি করা হয় এই রশি। ইসকনের সহ-সভাপতি রাধারমন দাসের রথে চড়িয়ে দেন বলভদ্র, জগন্নাথ এবং সুভদ্রাকে। সামগ্রিক এই রীতিকেই উদ্দেশ্য করে রাধারমন জানান, অনুষ্ঠানটিকে বলা হয় ‘পাহান্ডি বিজয়’ অর্থাৎ পায়ে হেঁটে রথে চড়েন জগন্নাথ। হাতে খোল-করতাল নিয়ে রথের সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয় দিঘার রাজপথ।

    প্রায় ঘন্টা দুয়েক রথযাত্রার পর পৌনে এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তিনটি সুসজ্জিত রথ পৌঁছয় সমুদ্র সৈকতের মাসির বাড়িতে। প্রথমে বলভদ্র এবং সুভদ্রাকে রথ থেকে নামিয়ে মাসির বাড়িতে আনা হয়। এরপরে কীর্তন সহযোগে আনা হয় জগন্নাথদেবকে। মাসির বাড়িতে প্রবেশের পরও জগন্নাথদেবের আরতি করেন মুখ্যমন্ত্রী।

    তারপরেই যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠান শেষে সেখান থেকেই হোটেলের উদ্দেশে রওনা দেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। আগামী সাতদিন মাসির বাড়িতেই থাকবেন প্রভু, তারপর ফিরবেন মূল মন্দিরে। উল্লেখ্য, এই রথের রশিতে টান দেওয়ার অপেক্ষায় থাকেন হিন্দুরা। রথযাত্রায় পুরীতে গিয়ে লক্ষাধিক ভিড় ঠেলে, হাজার কষ্ট সহ্য করেও রশিতে টান দেওয়ার সৌভাগ্য হয় না অনেকেরই। তবে মুখ্যমন্ত্রীর পরিকল্পনায় কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়া সত্ত্বেও এই সৌভাগ্য হয়েছে দিঘায় উপস্থিত প্রত্যেক দর্শণার্থীদের। বুধবার বিকেলেই তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন সমুদ্র সৈকতে।

    বৃহস্পতিবার সামগ্রিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, পদপিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা এড়াতে রাস্তার দু’ধারে ব্যারিকেড করা হচ্ছে। ব্যারিকেডের ওপার থেকে রথ দেখতে পারবেন সাধারণ মানুষ। তা ছাড়া ব্যারিকেডের সঙ্গে রথের রশিও লাগানো থাকবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। ফলে দু’ধারের ব্যারিকেডের ওপারে থাকা মানুষ রথের দড়িও ছুঁতে পারবেন। মুখ্যমন্ত্রী এও জানিয়েছিলেন, সাধারণ মানুষের জন্য রথ যেতে যেতে কিছুটা সময় থামবে। তাঁর এই পরিকল্পনার কিছুই ব্যতিক্রম হয়নি। রথের পবিত্র রশি স্পর্শ করে ভক্তিরসে মাতলেন ভক্তরা। উৎসবকে সফল করতে পুলিশ-প্রশাসনের প্রস্তুতিও ছিল দেখার মত। বহু জেলা থেকে আসা পুলিশ ফোর্স নিয়োজিত হয়েছিল এই বিপুল ভিড় সামলাতে। তিন স্তরের নিরাপত্তায় মোড়া হয়েছিল দিঘা। সার্বিকভাবে, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি দিঘার বুকে। এদিন বৃষ্টি উপেক্ষা করেও জগন্নাথধামে নামে মানুষের ঢল।

    প্রভুর যাত্রাপথের দু’ধারের ব্যারিকেডের পাশে জনপ্লাবন সৃষ্টি হয়। কেউ হাত জোর করে কেবল চেয়ে থাকেন প্রভুর দিকে, আবার কেউ কীর্তনের তালে নাচতেও থাকেন। চলতি বছরের রথযাত্রায় দিঘা যেন নিজেই এক নতুন ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, যেখানে সমুদ্রের ঢেউ এবং ভক্তির স্রোত একসঙ্গে মিলেছে। এই প্রথম দিঘা এমন এক মহোৎসবের স্বাদ পেল, যা শুধু ইতিহাসে নয় বরং মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। এদিনের উৎসবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, ইন্দ্রনীল সেন, পুলক রায়, স্নেহাশিস চক্রবর্তী, সুজিত বোস, রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার, মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, কলকাতা ইসকনের সদস্য রাধারমণ দাস-সহ প্রমুখ প্রশাসনিক কর্তারা।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)