অঙ্গদাতা ভাই কেমন আছে, গ্রহীতার বাড়ি খুঁজে দেখতে গেলেন দাদা
বর্তমান | ২৯ জুন ২০২৫
বিশ্বজিৎ দাস, কলকাতা: আইন বলছে, অঙ্গদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে যোগাযোগ মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়াও অনুচিত। কিন্তু বাস্তব বহু ক্ষেত্রেই সিনেমাকে হার মানায়। এই হাসি-কান্নার রূঢ় বাস্তবে এক অঙ্গদাতার দাদা খুঁজে বের করলেন, ভাইয়ের ‘দানের হৃদয়’ বসেছে কার দেহে। কোথায় আছেন, কেমন আছেন তিনি। শুধু খুঁজে বেরই করলেন না, হাওড়ার সেই কৃতজ্ঞ গ্রহীতার পরিবারের সঙ্গে দিনের পর পর দিন কথা বললেন। বন্ধুত্বও হল দু’তরফের। একসময় গ্রহীতা ও তাঁর পরিবার দাতার বাড়ি আসতে চাইলেন। তখন থমকালেন দাদা। তাঁর ভাই রাকেশ যে আজও ‘জীবিত’ তাঁর বাবা-মায়ের কাছে। রাকেশের হার্ট যাঁর শরীরে গিয়েছে, সেই দেবযানীকে (নাম পরিবর্তিত) দেখলে ঠিক থাকতে পারবেন কি বাবা-মা? এই আশঙ্কা থেকে আপাতত ‘অদ্ভূত’ সম্পর্কে দাঁড়ি টেনেছেন দাদা। তিনি স্বাস্থ্যদপ্তরে কর্মরত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ডাঃ রাহুল দাস।
শনিবার রাহুলবাবু বলেন, ‘লক্ষণরেখা অতিক্রম করব না আমরা। দেবযানীকে দেখলে বাবা-মাকে সামলে রাখতে পারব না। ওঁরা যাতে সব ভুলে থাকতে পারেন, সে জন্য বাড়ির কাছে দোকান করে দিয়েছি। নিজের কাছে নিয়ে এসেছি। তাও কি ভোলা যায়? মা রোজ আমাদের জনমানবহীন পুরনো বাড়িতে ভাইকে দেখতে যায়। মনে করতে যায়। জানি না, হয়ত ওই বাড়িটা একদিন বিক্রি করে দিতে হবে।’
ঘটনার সূত্রপাত ২০২২ সালে। ২৯ সেপ্টেম্বর বাইক রেস করতে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন ভাঙড়ের নিউ বামনঘাটার বাসিন্দা ২১ বছরের রাকেশ। তিন ডিসেম্বর তাঁর ব্রেন ডেথ ঘোষণা হয়। তারপর বাড়ির লোকজনের সম্মতিক্রমে ভাইয়ের অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত নেন রাহুল। ভাইয়ের দু’টি কিডনি পান নদীয়া এবং কলকাতার ভবানীপুরের দুই রোগী। লিভার পান দিল্লির এক প্রাইভেট হাসপাতালের রোগী। আর হার্টটি পান হাওড়ার ১৭ বছরের প্রাণচঞ্চল এক কিশোরী দেবযানী শর্মা (নাম পরিবর্তিত)।
কিন্তু ভাই অন্ত প্রাণ দাদা রাহুল এবং তাঁর বাবা-মা আজও মনে করেন, রাকেশ মারা যায়নি। সে জীবিতই আছে গ্রহীতাদের শরীরে। মৃত্যুর ঘটনার তিন বছর পর আজও আবেগতাড়িত রাহুল। শনিবার বলেন, ‘জানেন আমরা শাস্ত্রমতে ভাইয়ের দাহকার্য করি। কিন্তু শ্রাদ্ধ করিনি। কারণ আমাদের বিশ্বাস ছিল তা করলে গ্রহীতাদের বিপদ হতে পারে। পুরোহিতদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরাও বলেছেন, আপনার ভাই শ্রেষ্ঠ দান, জীবনদান করেছেন। তা ক’জন করতে পারেন!’ রাহুল বলে চলেন... ‘এরপর বহু খুঁজে এক গ্রহীতার নম্বর জোগাড় করি। একদিন হাওড়ায় ওঁর বাড়ি যাই। ওঁকে দেখে আমি অবাক। মনে হল যেন ভাইকে দেখছি। পরিবারটি অসাধারণ। বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। তারপর থেকে কথা হতো। মাস আটেক আগেও কথা হয়েছে। ওঁরা আসতে চাইছিলেন আমাদের বাড়ি। তবে আমি সেখানেই দাঁড়ি টেনে দিয়েছি। বাবা-মা ওঁকে দেখলেই ভাইয়ের কথা মনে করবে? তখন সামলানো কঠিন হতো?’
দেবযানীর হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করেছিলেন সার্জন ডাঃ দেবাশিস দাস। তিনি বলেন, ‘ঠিকই করেছেন রাকেশ। অঙ্গদান সেরা দান। কিন্তু দাতা ও গ্রহীতার পরিবারের সম্পর্ক না হওয়াই উচিত। আবেগ ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হতে পারে। ও ভালো আছে। নিয়মমতো চেক আপ করে। এখন বয়স ২০ বছর। সবে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে। রাকেশের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই ওঁদের।’ আর ডাঃ রাহুল দাস বলেন, ‘ভাইকে প্রতি সেকেন্ড অনুভব করি। বুঝি ও কোথাও যায়নি। ও আছে। দেবযানী ও গ্রহীতাদের শরীরে ও বেঁচে আছে। ওঁরা যে যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।’