হুমকি, আটকে রেখে মারধর— এ সব যে মনোজিৎ মিশ্রের রোজকার কারবার ছিল, আইন কলেজের ছাত্রীর গণধর্ষণের ঘটনায় ধরা পড়ার পরে তার সম্পর্কে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এ বার সামনে আসছে তার মানসিক বিকৃতির একাধিক তথ্যও!
আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ–খুনে সাজাপ্রাপ্ত সঞ্জয় রায়ের বিকৃত মানসিকতার ভূরি ভূরি উদাহরণ সামনে এসেছিল। যৌন বিকৃতি থেকে মোবাইল ফোনে পর্নোগ্রাফি রাখার মতো নানা তথ্য উঠে এসেছিল পুলিশি তদন্তে।
সেই ধর্ষকের ফাঁসি চেয়ে যখন সরব গোটা দেশ, তখন তাতে সুর মিলিয়েছিল মনোজিৎও। ফেসবুকে করা তার সেই পোস্ট এখন ভাইরাল। আবার আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে ‘রাত দখল’ কর্মসূচিতে তারই কলেজের যে পড়ুয়ারা যোগ দিয়েছিল, তাদের ধরে ধরে হুমকি ও মারধরের অভিযোগও উঠেছিল মনোজিতের বিরুদ্ধে।
সময় যত গড়াচ্ছে জানা যাচ্ছে, ততই তার নানা বিকৃত কার্যকলাপ প্রকাশ্যে আসছে। মহিলাদের নানা অঙ্গের ছবি তুলে মোবাইলে রাখা, ক্লোজ়ড সার্কল-এ ছাত্রীদের নানা আপত্তিকর ছবি-ভিডিয়ো শেয়ার করে শেমিং করা থেকে নানা লোকজনকে মারধর করে সেই ভিডিয়োও মোবাইল জমিয়ে রাখত অভিযুক্ত— এমনই জানাচ্ছে তার ঘনিষ্ঠ মহল, বন্ধুবান্ধব এবং জুনিয়ররা।
এমনকী তার এই বিকৃতি থেকে রেহাই পাননি মনোজিতের এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীও। কলেজ সূত্রে খবর, নিজেদের সঙ্গম-মুহূর্তের ভিডিয়ো তুলে সেই সব দেখাত মনোজিৎ। কয়েক বছর আগে কোনও ভাবে সেই ভিডিয়ো লিক হয়ে যাওয়ায় সেই বান্ধবীর সঙ্গে তার সম্পর্কে সাময়িক ছেদ পড়ে বলেও জানা গিয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে গুন্ডামির অভিযোগ উঠেছে এই কীর্তিমানের নামে। আরজি করের পরে রাত দখলে যাওয়া পড়ুয়াদের সে ক্যাম্পাসে গত এক বছর ধরে ঢুকতে দেয়নি বলেও অভিযোগ।
পাশাপাশি বহু ছাত্রছাত্রীকে নানা সময়ে হেনস্থাতেও নাম জড়িয়েছে তার। সেই হেনস্থার ভিডিয়ো তুলে সেই সব ভিডিয়ো নানা সময়ে দেখত এবং তার শাগরেদদের দেখাত মনোজিৎ।
ক্যাম্পাসে নতুন ছাত্রীদের পছন্দ হলেই সে গিয়ে বলত, ‘তুই আমাকে বিয়ে করবি?’ এই ছিল তার কথা শুরু করার পদ্ধতি। প্রসঙ্গত, নির্যাতিতা ছাত্রীও তাঁর অভিযোগপত্রে লিখেছেন যে মনোজিৎ তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তাতে রাজি না হওয়াতেই শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার।
কলেজ ট্রিপে গিয়েও মেয়েদের ‘হান্ট’ করে বেড়াত এই অভিযুক্ত। এক ছাত্রীর কথায়, ‘আমাকে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা ধরে কলেজ ট্রিপে গিয়ে খুঁজেছিল মনোজিৎ। আমি ওর চাহনি দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, ও কী চায়। তাই লুকিয়েছিলাম। কেন ও ট্রিপে দেখতে পায়নি এ নিয়ে আমাকে পরে কথাও শুনিয়েছিল।’
ক্যাম্পাসে দেদার নেশার চক্র চালানোর পাশাপাশি মনোজিতের বিকৃত শখ মেটাতে অনেক পড়ুয়াই বাধ্য হতো সহপাঠী ছাত্রীদের শরীরের নানা অংশের আপত্তিকর ছবি তুলে দেখাতে। সে নিজেও নানা সময়ে অনেকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে বলে সূত্রের খবর।
ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের সেই ছবি-ভিডিয়ো অনেককেই দেখিয়েছে সে। দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রের কথায়, ‘সেই সব ছবি দেখিয়ে ও কৃতিত্ব নিত। আর কতজনের সঙ্গে এমন সম্পর্কে জড়িয়েছে, তারও হিসেব রাখত। যে সব ভিডিয়ো আমাদের দেখিয়েছে, তাতে দেখে বোঝা যেত ও অত্যন্ত রাফ সেক্স করত। মারধর, যন্ত্রণার ভিডিয়ো দেখতে এবং দেখাতে ভালোবাসত। দেখতে না চাইলেও জোর করে দেখাত।’
পড়ুয়াদের অনেকেরই দাবি, এই সব বিষয়ে একাধিকবার কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কেউ ওর কিছু করতে পারেনি।
এতটাই প্রভাব ছিল মনোজিতের। ২০২২ সালে ছাত্রীরা জোট বেঁধে কমপ্লেন করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এই অভিযুক্তর বিরুদ্ধে। এমনকী গড়িয়াহাট, কসবা, যাদবপুর— নানা থানায় তার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানি থেকে অপহরণ, মারধরের অভিযোগ থাকলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানাচ্ছেন মনোজিৎকে কাছ থেকে চেনা অনেকেই।