কসবাকাণ্ডে সিট গড়ে তদন্ত শুরু করেছে লালবাজার। শনিবার গ্রেফতার করা হয়েছে সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের নিরাপত্তারক্ষীকে, যাঁর ঘরে আইনের এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। পাশাপাশিই, নির্যাতিতার গোপন জবানবন্দি নিয়েছে লালবাজার। ঘটনার পুনর্নির্মাণও করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে খবর, ঘটনার সময়কার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। নির্যাতিতার বয়ানের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তদন্ত।
আরজি কর-কাণ্ডের পর বছর ঘুরতে না-ঘুরতেই শহরে আরও একটি ধর্ষণের ঘটনায় রাজ্য সরকার এবং শাসকদলের বিরুদ্ধে সুর চড়াতে শুরু করেছে বিজেপি। শনিবারও কলকাতার পাশাপাশি রাজ্যের নানা জায়গায় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখিয়েছে বিজেপি। কিন্তু কসবার ঘটনায় রাজ্য জুড়ে সর্বাত্মক আন্দোলন চাওয়া পদ্মের তাল কেটে দিলেন দলেরই বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। আরজি কর-কাণ্ডের তদন্তে সিবিআই ‘সফল নয়’ বলে দাবি করে রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদিকা, আসানসোল দক্ষিণের বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পুলিশি তদন্তের পক্ষেই সওয়াল করে বসলেন!
মহিলা মোর্চার রাজ্য সভানেত্রী ফাল্গুনী পাত্রকে সঙ্গে নিয়ে অগ্নিমিত্রা শনিবার যে সাংবাদিক বৈঠক করবেন, সে কথা শুক্রবার রাতেই বিজেপির তরফ থেকে জানানো হয়েছিল। কসবাকাণ্ড নিয়ে সুর চড়াতেই সম্ভবত দুই মহিলা মুখকে সামনে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিজেপি। সেইমতো কসবাকাণ্ডের তদন্ত কোন সংস্থার হাতে থাকা উচিত, এ বিষয়ে অগ্নিমিত্রাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আরজি কর মামলায় সিবিআই সফল নয়, এটা আমি আপনার সঙ্গে সহমত।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আমরা সিবিআই চাই না, আমরা চাই তদন্ত এই পুলিশই করুক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ, যার মাইনে হয় আপনার-আমার করের টাকায়, আপনারা তদন্ত করবেন। সত্যিটা সামনে আসুক।’’
অগ্নিমিত্রার এই মন্তব্যকেই হাতিয়ার করে পাল্টা আক্রমণ শানাতে শুরু করেছে তৃণমূল। শাসকদলের তরফে সমাজমাধ্যমে লেখা হয়েছে, ‘‘তিনি (অগ্নিমিত্রা) এখন মহিলাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এবং কলকাতা পুলিশের উপরে আস্থা রাখছেন।’’ গোটা ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই অস্বস্তিতে পড়েছে বিজেপি। অগ্নিমিত্রার বক্তব্যকে ‘ব্যক্তিগত মত’ বলে তুলে ধরে দূরত্ব রচনা করার চেষ্টা করেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। সুকান্ত বলেছেন, ‘‘এটা আমাদের দলগত অবস্থান নয়। এটা ওঁর ব্যক্তিগত মত।’’
ঘটনাচক্রে, সাংবাদিক বৈঠকে মন্তব্যটি করার পরে অগ্নিমিত্রা নিজেও সম্ভবত বুঝেছিলেন যে, তাঁর এই মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হতে পারে। তাই পরের বাক্যেই তিনি বলেন, ‘‘আমি ব্যক্তি অগ্নিমিত্রা বলছি যে, আমি সিবিআই চাইছি না। আমি কেন সব সময় সিবিআই চাইব? আমার মাইনের টাকায় পুলিশ রয়েছে। তারা কি শুধু তোলাবাজি করবে? আর তৃণমূলের সিন্ডিকেট চালাবে? আর কাটমানিগুলোকে কালীঘাটে আর শান্তিনিকেতনে পাঠাবে? সেটাই তাদের কাজ?’’ অগ্নিমিত্রার ব্যাখ্যা, তিনি বলতে চেয়েছেন, যার যা কাজ, সেটা তাকেই করতে হবে। সেই অর্থেই তিনি বলেছেন যে, পুলিশকেই তদন্ত করে সত্য সামনে আনতে হবে এবং অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সিট গড়ল লালবাজার
কসবার কলেজে গণধর্ষণের ঘটনায় বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করল কলকাতা পুলিশ। পাঁচ সদস্যের ওই তদন্তকারী দলের নেতৃত্বে রয়েছেন কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ শহরতলি) প্রদীপকুমার ঘোষাল। পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার নির্যাতিতার মেডিক্যাল পরীক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে। কাউন্সেলিংও করানো হয়েছে তাঁর।
রক্ষী গ্রেফতার
সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের ৫৫ বছর বয়সি নিরাপত্তারক্ষীকেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নির্যাতিতা অভিযোগপত্রে জানিয়েছেন, ঘটনার সময়ে রক্ষী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন ‘অসহায় সাক্ষী’। তাই নির্যাতিতাকে কোনও সাহায্য করতে পারেননি। এমনকি, রক্ষীর ঘরে (গার্ডরুমে) নিয়ে গিয়েই তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ওই ছাত্রী। সেই সময়ে ঘরের বাইরে রক্ষীকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। শুক্রবার রাতে পুলিশ ওই নিরাপত্তারক্ষীকে গ্রেফতার করেছে। অভিযোগ, তাঁর বয়ানে অসঙ্গতি ছিল।
হাতে সিসি ফুটেজ
পুলিশ সূত্রে খবর, কলেজে ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় তদন্তের অন্যতম হাতিয়ার হতে চলেছে সিসিটিভি ফুটেজ। নির্যাতিতার বয়ান অনুযায়ী, তাঁকে প্রথমে ইউনিয়ন রুমে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল। তার পর নিয়ে যাওয়া হয় কলেজের রক্ষীর ঘরে (গার্ড রুমে)। সেখানে ধর্ষিতা হন ওই ছাত্রী। ইউনিয়ন রুমের বাইরে একটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। সূত্রের খবর, তার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। সেগুলি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তকারীদের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, কলেজ ক্যাম্পাসের মোট দু’টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এই ঘটনায় তদন্তের কাজে লাগতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলতে পারে ওই ফুটেজগুলি থেকে। ইউনিয়ন রুমের বাইরে সে দিন রাতে কারা দাঁড়িয়ে ছিলেন, কী করছিলেন, রক্ষী কোথায় ছিলেন, এই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। নির্যাতিতার বয়ান রেকর্ড করা হয়েছে। আরও কেউ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কি না, খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
সুকান্তদের প্রতিবাদ
কসবাকাণ্ডের প্রতিবাদে শনিবারও পথে নেমেছিল বিজেপি। গড়িয়াহাট মোড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল তাদের। নেতৃত্বে ছিলেন সুকান্ত। ওই কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দেয় বলে অভিযোগ। তার জেরেই পুলিশের সঙ্গে বিজেপি কর্মীদের ধস্তাধস্তি হয়। বিজেপির অভিযোগ, তাদের কয়েক জন কর্মীকে পাকড়াও করে প্রিজ়ন ভ্যানে তুলেছে পুলিশ। প্রিজ়ন ভ্যানে তোলা হয়েছিল সুকান্তকেও। সুকান্ত এ নিয়ে আঙুল তুলেছেন রাজ্য সরকার এবং পুলিশের দিকে। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা থানা ভাঙতে যাইনি। প্রতিবাদ করছিলাম। পুলিশ আটকে দিল।’’ এর পরে তিনি রাজ্য সরকারকে ধিক্কার দিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। ধর্ষণ নিয়ে রাজ্য সরকারের দিকে আঙুল তুলেছেন সুকান্ত। তিনি বলেন, ‘‘একটি বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষিতা হতে হয়েছে।’’ এই নিয়ে তিনি তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে আঙুল তুলেছেন।
নড্ডার অনুসন্ধান কমিটি
কলকাতার কসবায় আইন কলেজে ধর্ষণকাণ্ডে এ বার নিজস্ব অনুসন্ধান কমিটি গঠন করল বিজেপি। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা চার সদস্যের এই কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। ওই কমিটির সদস্যেরা শীঘ্রই পশ্চিমবঙ্গে আসবেন। তাঁরা ঘটনাস্থলে যাবেন এবং তার পরে একটি রিপোর্ট তৈরি করে জমা দেবেন নড্ডার কাছে। চার সদস্যের ওই কমিটিতে রয়েছেন দুই প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সত্যপাল সিংহ এবং মীনাক্ষী লেখী। এ ছাড়া বিজেপির লোকসভার সাংসদ বিপ্লবকুমার দেব এবং রাজ্যসভার সাংসদ মননকুমার মিশ্রও রয়েছেন ওই কমিটিতে। বিজেপির এই অনুসন্ধান কমিটিতে সত্যপাল এবং বিপ্লবের থাকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। মুম্বইয়ের প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার সত্যপাল বর্তমানে বিজেপির নেতা। অন্য দিকে, বিপ্লব ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গে এসে বিজেপির অনুসন্ধান কমিটির যাতে ভাষাগত সমস্যা না হয়, অনুমান করা হচ্ছে সেই কারণেই বিপ্লবকে রাখা হয়েছে এই দলে।
তৃণমূলের কটাক্ষ
বিজেপির অনুসন্ধান কমিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলার শাসকদল তৃণমূল। এই কমিটি বাংলায় এসে কী করবে, তা নিয়ে শনিবার তৃণমূল ভবনে সাংবাদিক বৈঠকে প্রশ্ন তুলেছেন কুণাল ঘোষ। কসবাকাণ্ডে অভিযুক্তদের যে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে, তা-ও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি।