• নিরাপত্তারক্ষীর ঘরই ছিল ‘এমএম’-এর প্রমোদকক্ষ
    আনন্দবাজার | ২৯ জুন ২০২৫
  • রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে শেষ পর্যন্ত দরপত্র কে পাবে সেই নিয়েই জটিলতা চলছে বছরের পর বছর। অভিযোগ, সে কারণে কলেজের এক তলায় জায়গা চিহ্নিত হলেও কলেজ ক্যান্টিন তৈরি হয়নি। সেই ক্যান্টিনের জায়গা বলে চিহ্নিত অংশের ভিতরেই এক দিকে ছোট্ট একফালি ঘর। কয়েক বছর আগে সেই ঘরই ‘গার্ডের ঘর’ (নিরাপত্তারক্ষীর কক্ষ) বলে চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন কলেজ ইউনিয়নের দাদারা। কিন্তু অভিযোগ, সেই ঘরে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল নিরাপত্তারক্ষীদেরও। ঘরের বাইরে বেঞ্চে রাতে প্রয়োজনে বিশ্রামটুকু নেওয়া ছাড়া সে দিকে যাওয়ারই সুযোগ ছিল না তাঁদের। সঞ্জীব শীল নামে এমনই এক নিরাপত্তারক্ষী শনিবার বললেন, ‘‘শুধু ‘এম’-এর এবং তার আস্থাভাজনদেরই প্রবেশের অনুমতি ছিল সেখানে।’’ কলেজের ছাত্রদের দাবি, ওই ঘর নাকি এমএম-এর ‘হ্যাংআউট জ়োন’!

    দক্ষিণ কলকাতা আইন কলেজের এই ঘরে বুধবার সন্ধ্যায় সেখানকারই এক ছাত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। পুলিশ ঘরটিকে সিল করে দিয়েছে। ঘরের সমস্ত জানালায় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে কার্ডবোর্ডের আস্তরণ। বোর্ড লাগিয়ে সিল করা হয়েছে ইউনিয়নের ঘরের জানলাও। অভিযোগ, ইউনিয়নের ঘরে প্রথমে নির্যাতন চালিয়ে ওই তরুণীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নিরাপত্তারক্ষীর ঘর বলে চিহ্নিত ওই জায়গায়।

    ল কলেজের পড়ুয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই জানা যায় সেই ঘর সম্পর্কে নানান তথ্য।তাঁদের দাবি, কলেজে এমের অ্যান্টি চেম্বার হিসেবে ব্যবহার হত ওই ঘর। সেখানে গত কয়েক বছরে এমের প্রয়োজনমতো সমস্ত কিছু এনে ভরানো হয়েছে। আগে সেখানে কিছু বেঞ্চ পাতা থাকত, এখন সেখানে চেয়ার-টেবিল আনিয়ে রাখা হয়েছে। যে চেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে রেখে কথা বলতে দেখা যেত এমকে। বাইরে সর্বক্ষণ পাহারায় থাকতেন এমের আস্থাভাজন পড়ুয়াদের কেউ না কেউ। ওই ঘরেই ছোট একটি খাট, এমনকি রেফ্রিজারেটরও আনিয়ে রাখা হয়েছিল। কলেজের সময়ে এম বাইরে থাকলে সেই ঘর বন্ধ থাকত। পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলতে হলে ইউনিয়ন রুমেই যেত এম। সন্ধ্যার পর বা ছুটির দিনের দুপুরে ওই ঘরে পাওয়া যেত এমকে।

    বর্তমানে ল কলেজের তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়া এক ছাত্রের দাবি, “সন্ধ্যার পরে নানান নেশার সামগ্রী ঢুকত সেখানে। মধ্যরাত পর্যন্ত পার্টি চলত একাধিক দিন। দাদার যাঁকে যাঁকে পছন্দ হত, তাঁদের ওই ঘরে হাজিরা দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। নয়তো তাঁরা পরীক্ষায় বসতে পারবেন না। কলেজে এলেই নিগ্রহের শিকার হবেন।” দ্বিতীয় বর্ষের আর এক পড়ুয়ার দাবি, কলেজের ভর্তির প্রক্রিয়া ওই ঘর থেকেই নিয়ন্ত্রিত হত। কোনও অনুষ্ঠান হলে ওই ঘর থেকে সমস্ত কিছু ঠিক করা হত। ইউনিয়নের কোনও কাজে কত টাকা কলেজ খরচ করবে, সে সবও ওই ঘর থেকে আসা নির্দেশ মেনে কলেজ কর্তৃপক্ষকে করতে হত বলে অভিযোগ। সদ্য প্রাক্তন এক পড়ুয়ার আবার অভিযোগ, ২০২২ সালে ওই ঘরেই এক ছাত্রীকে ডেকে একই ভাবে নিগ্রহ করেছিল এম। একই ভাবে ভিডিয়ো তুলে রেখে ব্ল্যাকমেল করা শুরু করে সে। সেই সময়ে পুলিশে অভিযোগ করেও লাভ হয়নি।

    একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা থেকে ল কলেজে নিরাপত্তারক্ষী পাঠানো হত। সেখানকার মালিক তথা প্রাক্তন সেনাকর্মী বিমলচন্দ্র দাস বললেন, “এম এবং তার দলবল নিরাপত্তারক্ষীদের মারধর করত। কলেজ কর্তৃপক্ষকে বলেও লাভ হয়নি।” নিরাপত্তারক্ষী সঞ্জীব বললেন, “এমের ওই ঘরে রাত পর্যন্ত যা যা চলত, তা বলার নয়। সাউন্ড বক্স চালিয়ে উত্তাল নাচ দেখেছিবহু রাতে।”

    ওই ঘর সম্পর্কে কলেজ কর্তৃপক্ষ কি কিছুই জানেন না? উপাধ্যক্ষ নয়না চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “কোন ঘরে কী হচ্ছে, সব সময় তো আমার পক্ষে গিয়ে দেখা সম্ভব নয়! ক্যান্টিন তৈরি না হওয়ার ব্যাপারটা পরিচালন সমিতি বলতে পারবে। তবে নানা স্তর থেকে বাধা আসার কারণে অনেক কিছু করে ওঠা যায়নি।” কার বাধা? কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি তৃণমূল বিধায়ক অশোক দেব জবাবে ফোনে বলেন, “সোমবার বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে যা বলার বলব।”
  • Link to this news (আনন্দবাজার)