এ রাজ্যে ভোটার তালিকার বিশেষ এবং নিবিড় সমীক্ষা (স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর) হয়েছিল প্রায় দু’যুগ আগে। বিহারে এই প্রক্রিয়ার উদাহরণ টেনে ইতিমধ্যেই সুর চড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও জাতীয় নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য, সংবিধানের ৩২৪ ধারা অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময় অন্তর এই পদক্ষেপ করার কথা। যা দীর্ঘদিন ধরে ব্রাত্য ছিল। এ বার শীঘ্রই এসআইআর শুরু হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গেও। তার ভিত্তিতে তৈরি চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ধরেই আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা ভোট হবে। ক্রমে এসআইআর হবে গোটা দেশে।
কমিশন সূত্র জানাচ্ছে, এ রাজ্যে শেষ বার এসআইআর প্রকাশিত হয়েছিল ২০০২ সালে। এর মধ্যে এ রাজ্যে ভুয়ো নথির দৌলতে ভোটার হওয়া বাংলাদেশি এবং পাকিস্তানের নাগরিকের উপস্থিতিও টের পাওয়া গিয়েছে। তাই ভুয়ো নথি সমস্যার গোড়ায় আঘাত করতে গেলে সুরক্ষার প্রশ্নে এসআইআর জরুরি।
কী হবে নিবিড় সমীক্ষায়? কমিশন-সূত্র জানাচ্ছে, রাজ্যে মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) নেতৃত্বে জেলা নির্বাচনী আধিকারিক বা জেলাশাসকে (ডিইও), ভোটের অতিরিক্ত জেলাশাসক, ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার, অতিরিক্ত ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার এবং বুথ লেভেল অফিসারেরা (বিএলও) একত্রে ভোটার তালিকায় নাম থাকা প্রত্যেকের বাড়িতে সমীক্ষার কাজটি করবেন। তাতে একটি ফর্ম ভরে প্রয়োজনীয় তথ্য দাখিল করতে হবে এক-এক জনকে। তা যাচাই হবে। তবে ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি প্রকাশিত এসআইআর তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিদের অতিরিক্ত নথি দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। আবার যাঁদের অভিভাবকের নাম সেই তালিকায় রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রেও সমস্যা নেই। তবে সেই তালিকায় যাঁদের নাম নেই, নতুন ভোটার বা অন্য রাজ্য থেকে চলে আসা কোনও ব্যক্তির ক্ষেত্রে পৃথক ফর্ম এবং নথি দাখিল করতে হবে (সবিস্তার সারণিতে)। কমিশনের এক কর্তার কথায়, “সেই তালিকায় যাঁদের নাম থাকবে না, তাঁদেরই পারিবারিক এবং এ দেশের নাগরিকত্বের সূত্র বুঝতে নথি যাচাই হবে। অনলাইনেও এই প্রক্রিয়া চালানো যাবে। গোটা প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিও যুক্ত থাকবেন। যাঁরা এ কাজ করবেন, তাঁরা রাজ্য সরকারেরই কর্মচারী। দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার স্বার্থে এবং সরকারি অর্থের অপচয় ঠেকাতে ভুয়ো ভোটার বাদ দেওয়া জরুরি।”
কমিশন জানাচ্ছে, কোন নথির ভিত্তিতে ভোটারেরা কার্ড পাচ্ছেন, ২০২৩-এর আগে সেই তথ্য সংরক্ষিত থাকত না। ফলে গরমিল ধরা পড়লে বোঝার উপায় নেই, সংশ্লিষ্ট কোন নথির ভিত্তিতে তাঁরা কার্ড করিয়েছেন। নতুন পদ্ধতিতে প্রতিটি নথি কমিশনের ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষিত থাকবে। ফলে যে ভোটার যখনই কার্ড পান না কেন, তাঁর যোগ্যতা প্রমাণে কোনও বাধা থাকবে না।
এখনই কেন এই সমীক্ষা প্রয়োজন? কমিশন-কর্তারা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশি বা পাকিস্তানের নাগরিক হয়েও এ দেশের ভোটার কার্ড পাওয়ার ঘটনা সামনে আসছে। এমন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে একযোগে কাজ করছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, ‘ফরেনার্স রিজিয়োনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস’ (এফআরআরও) এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। বেশ কিছু দিন আগে অন্য একটি তদন্তের সূত্রে ইডি পাকিস্তানের এক নাগরিককে গ্রেফতার করে। তাকে জেরা করে ভুয়ো নথি চক্রের সন্ধান মিলেছে। ফলে কী ধরনের ভুয়ো নথির ভিত্তিতে অনেকে ভোটার কার্ড পেয়েছিলেন, তা জানতে কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছে ইডি।
গত বৃহস্পতিবার দিঘায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবৈধ অনুপ্রবেশের দায় কেন্দ্রের উপরেই ঠেলেছিলেন। তবে প্রশাসনের আধিকারিকদের একাংশ মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, অনুপ্রবেশ-নজরদারিতে কেন্দ্রের খামতি যেমন রয়েছে, তেমন নথি জোগাড়ে রাজ্যের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনের একাংশের ভূমিকা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁদের যুক্তি— রেশন, আধার বা ভোটার কার্ড তৈরি করতে গেলে ন্যূনতম কিছু নথি প্রয়োজন। যাতে প্রধানত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের একাংশের ভূমিকা থাকে। সেই স্তরে যাচাই, নজরদারিতে গাফিলতি বা অসাধু মনোভাব থাকলে নথি পাওয়া তেমন সমস্যার হয় না।