• রবীন্দ্রনাথের তৈরি ভাস্কর্যের নিলাম কোটিতে
    আনন্দবাজার | ২৯ জুন ২০২৫
  • প্রভাতকুমার মুখোপাধ‍্যায়ের রবীন্দ্র-জীবনীতে বলা আছে পাথরখণ্ডটির কথা। কর্নাটকের কারোয়ারে দাদা সত‍্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে থাকার সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তিনি একটি কোয়ার্টজ়াইট পাথর উপহার দিয়েছিলেন। ২২ বছরের তরুণ কবি তা হৃদয়ের আকারে কেটে পয়ার ছন্দে গাঁথা ক’টি পংক্তি খোদাই করেন, ‘পাষাণহৃদয় কেটে খোদিনু নিজের হাতে / আর কি মুছিবে লেখা অশ্রুবারিধারাপাতে’!

    এই কবিতা আর কোথাও বেরোয়নি। রবীন্দ্রনাথের হাতে গড়া আর কোনও ভাস্কর্যের কথাও কারও জানা নেই। প্রভাতকুমার জানিয়েছেন, ভাস্কর্যটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরম সুহৃদ অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীকে দিয়েছিলেন। এত বছর পরে চিত্রশিল্পী অতুল বসুর পরিবারের কাছে রক্ষিত ‘পাষাণ-হৃদয়’টি ‘জাতীয় শিল্প সম্পদ’ হিসেবে মুম্বইয়ে নিলাম হয়ে গেল। শুক্রবার সন্ধ‍্যার পরেও নিলামের চূড়ান্ত ফল নিয়ে উত্তেজনা জিইয়ে ছিল। ১৮৮৩-র রবীন্দ্রসৃষ্ট ভাস্কর্যটির দাম ৫৫-৭০ লক্ষ টাকা ধরা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা এক কোটি চার লক্ষ ৫২ হাজার ২১০ টাকায় বিক্রি হয়।

    ১৯২৭-১৯৩৬ সালের মধ্যে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ‍্যায়কে লেখা রবীন্দ্রনাথের ৩৫টি চিঠিও ১৪টি খামসুদ্ধ পাঁচ কোটি ৯০ লক্ষ টাকায় বিকিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের শিল্প, সঙ্গীত ভাবনার গুরুত্বপূর্ণ স্মারক চিঠিগুলি ১৯৭৩ সালে দেশ পত্রিকায় বেরোয়। তবে জাতীয় শিল্প সম্পদ হিসেবে এই রবীন্দ্রস্মৃতি ভারতীয় মুদ্রায় কেনা হয়েছে এবং তা দেশের বাইরে যাবে না বলে নিলামকারী সংস্থা অষ্টগুরুর তরফে জানানো হয়।রবীন্দ্রনাথের ‘অন্তরঙ্গ-জীবনী’ কবিমানসীতে কোয়ার্টজ়াইট পাথরের খণ্ডটি কাচমণি বলেছেন জগদীশ ভট্টাচার্য। নির্ভার সেই চিলতে পাষাণ-হৃদয় হাতের তেলোয় ধরা যায়। জগদীশের মতে, কারোয়ারের স্মৃতি রবীন্দ্রমানসে অক্ষয় থাকার কথা, কারণ নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে সেই তাঁর শেষ ভ্রমণ। ‘পাষাণ-হৃদয়’টিতে খোদাই করা রবীন্দ্র কবিতার সঙ্গে ‘সন্ধ‍্যাসংগীত’-এর ‘পাষাণী’র মিল তুলে ধরেন জগদীশ। কাদম্বরীর প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনুভূতির ছাপও কবিতাটিতে রয়েছে বলে তিনি আভাস দিয়েছেন।

    সেই ১৯৪১ সালে রবীন্দ্র প্রয়াণের ঠিক পরেই ক‍্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট-এর বিশেষ সংখ‍্যায় ছবি-সহ পাষাণ-হৃদয়টির কথা বেরোয়। এর পরে ২০২৩-এ কলকাতার দেবভাষা আর্ট গ‍্যালারিতে একটি প্রদর্শনীতে মেলে ধরা হয় হৃদয় খোঁড়া বেদনার এই লিপি। জানা যায়, অক্ষয় চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী রবীন্দ্রনাথের প্রিয়জন ‘লাহোরিনি’ শরৎকুমারীর (যাঁর জন্ম ও ছোটবেলা লাহোরে) কাছ থেকে তাঁদের কন‍্যা উমা কাচমণি পাথরের ভাস্কর্যটি পান। উমার পরে তাঁদের কন‍্যা, অতুল বসুর স্ত্রী দেবযানী তা পেয়েছিলেন।

    অতুল ও দেবযানীর বড় ছেলে অভিজিতের স্ত্রী ইলোরা আমেরিকার ব্লুমিংটন থেকে ফোনে আনন্দবাজারকে বললেন, “১৯৭০-এ আমার শ্বশুর, শাশুড়ির এই উপহারটি পাই। আমার শ্বশুরমশাই তখন বলেছিলেন, এ আমাদের পরিবারের মেয়েদের জিনিস! ওঁদের মেয়ে নেই বলে তা আমার প্রাপ‍্য হয়েছিল।” দীর্ঘদিন আমেরিকাবাসী অশীতিপর ইলোরা, অভিজিৎ। ইলোরা বললেন, “আমাদের পুত্র জয় অংশু বসু ছোট থেকে আমেরিকায়। বৌমা, নাতনি পুরোদস্তুর আমেরিকান। দেশে কারও কাছে থাকলেই রবীন্দ্রনাথের এই অপূর্ব স্মৃতি মর্যাদা পাবে ভেবে দেবভাষাকে বলি, ব‍্যবস্থা করতে।” দেবভাষার কর্ণধার সৌরভ দে, দেবজ‍্যোতি মুখোপাধ‍্যায়েরাই মুম্বইয়ে নিলামের বন্দোবস্ত করেন। নিলামকারী সংস্থাটির সিএমও মনোজ মনসুখানি জানান, এ দেশে থাকলেও রবীন্দ্রস্মারক কোথায় গেল, তা বলা যাবে না। তবে রবীন্দ্রস্মৃতির প্রতি এই টান এ দেশের সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক উত্তরাধিকারের মর্যাদার স্মারক।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)