স্কুলছুটদের বিদ্যালয়ে ফেরাতে বিনামূল্যে টিউশনি, স্কুল বাঁচাতে অভিনব উদ্যোগ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের
বর্তমান | ৩০ জুন ২০২৫
সংবাদদাতা, কাটোয়া: পরিবারে অভাব। বহু অভিভাবককেই তাঁদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া থেকে ছাড়িয়ে ভিনরাজ্যে কাজে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ বাড়ছিল স্কুলছুটের সংখ্যা। তাতে এলাকার একাধিক বিদ্যালয় ছাত্র-সঙ্কটে ভুগতে শুরু করে। সেই সঙ্কট মোকাবিলায় পথ খুঁজছিলেন কাটোয়ার রাজুয়া গ্রামের বেশ কয়েকজন সরকারি শিক্ষক-শিক্ষিকা। পেয়েছিলেন পথের সন্ধানও। সবাই মিলে ঠিক করলেন, ফ্রি পাঠশালা খুলবেন। সেখানে বিনামূল্যে পড়াবেন। ভালো রেজাল্ট করলে ভবিষ্যৎ ভালো হবে। স্কুলে আসার ঝোঁক বাড়বে। পড়াশোনায় আগ্রহ তৈরি হবে। যেমন ভাবনা তেমনিই কাজ। গ্রামে তাঁরা খুলে ফেললেন, ‘আমাদের পাঠশালা’। উদ্দেশ্য সফল। আশপাশের বহু গ্রাম থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তে আসছে। রাতের বেলা ক্লাস। তবে, পাঠশালায় যোগ দেওয়ার শর্ত একটাই—নতুন করে আবার স্কুলে ভর্তি হতে হবে৷ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে ব্লক প্রশাসনও৷
কাটোয়া-১ ব্লকের কোশিগ্রাম পঞ্চায়েতে রাজুয়া গ্রামের বাসিন্দা চুড়পুনি পশ্চিমপাড়া অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফিরোজ শেখ, শিক্ষিকা স্ত্রী ফৈজি সুলতানা সহ কয়েকজন শিক্ষককে নিয়েই তাঁর বাগান বাড়িতেই ‘আমাদের পাঠশালা’ খুলেছেন৷ বর্তমানে ৪৫ জন পড়ুয়া রয়েছে। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানে পড়ানো হয়৷ চার বছর ধরে স্কুলছুট রুখতে ফিরোজ সাহেবরা এমনই উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷ ফৈজি সুলতানা রাজুয়া চুড়পুনি অমলা বিদ্যাপীঠের বাংলা বিষয়ে পার্শ্বশিক্ষিকা৷ এছাড়াও পাঠশালায় পড়ান মোল্লা আব্দুল আলিম, ভাণ্ডারগড়িয়া প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক জাহিরুল ইসলাম, শ্রীখণ্ড মুসলিম অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা সৈয়দা সেলিনা বেগম। শিক্ষক ফিরোজ শেখ বলেন, ‘স্কুলছুটের শতাংশের হার বাড়ছে৷ গ্রামীণ এলাকায় দুঃস্থ ঘরের ছেলে মেয়েরা থাকে। অনেকেই স্কুল ছেড়ে ভিনরাজ্যে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে গিয়েছিল। তাদের ফিরিয়ে এনে পাঠশালায় আমরা পড়াচ্ছি। যাতে তাদের পড়াশুনার প্রতি আবার আগ্রহ বাড়ে। আমাদের পাঠশালায় কোনও বেতন নেওয়া হয় না৷ আমরা চাই প্রত্যেকেই শিক্ষার আলোয় আসুক৷’
রাজুয়া গ্রামের বাসিন্দা কল্যান ঘোষ, জয়নাল শেখরা বলছিলেন, ‘আমাদের ছেলে মেয়েরা রাতে মূলত বাড়িতে পড়াশুনা করতে চায় না৷ আমরাও সাধারণ খেটে খাওয়া পরিবারের মানুষজন৷ মোটা টাকা দিয়ে ছেলে মেয়েদের ভালো টিউশন দিতে পারি না৷ তাই শিক্ষকদের এমন উদ্যোগ আমাদের অবাক করে দিয়েছে৷ খুব ভালো চেষ্টা’।
গ্রামের গরিব পরিবারের সন্তান মইনুদ্দিন শেখ। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করছিল। ‘আমাদের পাঠশালার’ দৌলতে সে স্কুলে ফিরে এখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। মইনুদ্দিন বলছিল, ‘বাড়িতে অভাবের কারণে পঞ্চম শ্রেণির পর আর পড়তে পারিনি। পড়াশুনা ছেড়ে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করছিলাম৷ শিক্ষকরা আমাদের বাড়িতে গিয়ে বুঝিয়ে পাঠশালায় নিয়ে এসেছেন৷ এখন আমি প্রতিদিন স্কুলে যাই৷ আর কাজ করি না৷’ জাবেদা বিবি বলেন, ‘রাজুয়া, চুড়পুনি, যতীনপুর এসব গ্রামের বেশির ভাগ ছেলেরাই কেরল পাড়ি দিয়েছিল৷ তারা আবার ফিরে আসছে৷ বিনে পয়সার পাঠশালায় পড়ছে। স্কুলেও যাচ্ছে।’ শিক্ষক ফিরোজ সাহেব বলছিলেন, ‘সকালেও আমরা চেষ্টা করি পাঠশালা চালু রাখার৷’ কাটোয়া-১ বিডিও ইন্দ্রজিৎ মারিক বলেন, ‘শিক্ষকদের এমন উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয়।’ -নিজস্ব চিত্র