সঞ্চিতা মুখোপাধ্যায়, পুরুলিয়া
তার রূপ দেখার জন্য এখনও মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়েন যাত্রীরা। প্রবীণরা স্মরণ করেন নিজেদের ফেলে আসা যৌবনের কথা। নবীন প্রজন্ম অবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করে, নিছক বাষ্প দিয়ে দূরকে নিকট বন্ধু করার রহস্যটা ঠিক কোথায়! অতীতের গৌরব বুকে নিয়ে মানুষকে আজও মুগ্ধ করে চলেছে পুরুলিয়া কুইন।
পুরুলিয়া স্টেশনে ঢোকার মুখেই রয়েছে অতীতের বাষ্পীয় যুগের ইঞ্জিন। ভারতবর্ষে রেল লাইন পাতা শুরু হওয়ার পরে প্রথম দিকে বিভিন্ন কোম্পানি রেল লাইন পাতার দায়িত্বে ছিল।
তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ রেল কোম্পানি ছিল বেঙ্গল নাগপুর রেল, যাকে এককথায় সকলে চিনতেন বিএনআর নামে। হাওড়ার সঙ্গে বম্বের (বর্তমানে মুম্বই) যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি বিকল্প রুট আসানসোল-চক্রধরপুর রেলপথ। এই পথেই পড়ে পুরুলিয়া।
বিএনআর-এর তরফে রেলপথ স্থাপনের সঙ্গে ১৮৯০ সালে তৈরি হয় পুরুলিয়া স্টেশন। ১৯০৭ সালে পুরুলিয়া থেকে রাঁচি হয়ে লোহারডাগা পর্যন্ত শুরু হয় ন্যারোগেজ় ট্রেন চলাচল। জংশন হয়ে যায় পুরুলিয়া। ১৯৬০ সালে রাঁচি থেকে কোটশিলা হয়ে বোকারো পর্যন্ত হয়ে যায় ব্রডগেজ়। মাঝের মাত্র ৩৭ কিলোমিটার রেলপথ থেকে যায় ন্যারোগেজ়।
১৯৯২ সালে এই লাইন ব্রডগেজ় হওয়া পর্যন্ত এই ছোট্ট রেলপথে দু’টি কোচ নিয়ে চলত এক জোড়া প্যাসেঞ্জার ট্রেন। সেই ট্রেনের ইঞ্জিন-ই হলো পুরুলিয়া কুইন। যার রয়েছে এক বিস্তৃত ইতিহাস।
রেলের ইতিহাস ঘেঁটে জানা যাচ্ছে, ভারতের স্বাধীনতার এক বছর পরে প্যারিসে তৈরি হয়েছিল এই ইঞ্জিন। ১৯৫৩ সাল থেকে ভারতীয় রেলের পরিষেবায় যুক্ত হয় এই ইঞ্জিন। সেই হিসেবে টানা ৩৯ বছর সক্রিয় ছিল পুরুলিয়া কুইন।
৪৬ টন ওজনের এই ইঞ্জিনকে পুরুলিয়া কোটশিলা ন্যারোগেজ় শাখায় ১৯৮৬ সালের ১৮ অক্টোবর প্রথম চালানো হয়। টানা ১৯৯২ সালের ১৯ আগস্ট পর্যন্ত কাজ করে এই সুন্দরী ইঞ্জিন। পুরুলিয়া-কোটশিলা ন্যারোগেজ় লাইনকে সে সময়ে ছোট লাইন বলা হতো।
পুরুলিয়া শহরের দেশবন্ধু রোডের বাসিন্দা অচিন্ত্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় এখন অশীতিপর। কর্মজীবনের শুরুতে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের আদ্রা ডিভিশনে স্টেশন মাস্টার হিসেবে যোগ দেন তিনি।
বলছিলেন, ‘ছোট লাইনের ট্রেনে অনেকবার চেপেছি। পরে পুরুলিয়া স্টেশনে কাজ করার সময়ে সেই ট্রেনকে পাস করেছি। পেপার লাইন ক্লিয়ার টিকিট দেওয়া হতো ট্রেনের চালককে। তাতে কোটশিলা পর্যন্ত যাবার অনুমতি দেওয়া হতো।’
যোগ করলেন, ‘তার জন্য কোটশিলা স্টেশনের স্টেশন মাস্টারের কাছে একটি প্রাইভেট নম্বর নিতে হতো। ৩৭ কিলোমিটার এই রেলপথে কোনও সিগন্যাল ছিল না। পেপার লাইন ক্লিয়ার টিকিটই ছিল অনুমতিপত্র।’
পুরুলিয়ার সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী দেবাঞ্জলি ভকত, বর্ষা মুখোপাধ্যায়রা কখনও বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ট্রেনে চড়েননি। পুরুলিয়া কুইন-এর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বর্ষা বলে ওঠেন, ‘যদি এখনও সেই ট্রেন চলত, তা হলে চাপতাম। এখন শুধু সেলফি তুলি।’
পাল্টে গিয়েছে সময়। বদলে গিয়েছে পুরুলিয়া স্টেশনের আদলও। হারিয়ে গিয়েছে দু’টি মাঝারি মানের প্ল্যাটফর্ম। নেই কাঁকর দেওয়া রাস্তা। পুরোনো ওভারব্রীজ, পুরোনো স্টেশন বিল্ডিং, পুরোনো বুকিং অফিস, সব উধাও! রয়ে গিয়েছে পুরুলিয়া কুইন। একরাশ স্মৃতি আঁকড়ে সে বহন করে চলেছে অতীত ইতিহাস।