• তিন দশকে উধাও ৭৫ হাজার হেক্টর ঘন শালজঙ্গল, বলছে গবেষণা
    এই সময় | ৩০ জুন ২০২৫
  • সমীর মণ্ডল, মেদিনীপুর

    শাল পাতা কুড়ানো থেকে শুরু করে শাল জঙ্গল পরিষ্কার করেন বেশির ভাগ মহিলারা। শুধু তাই নয় শাল জঙ্গলের কাঠ তাঁরা জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করেন। কিন্তু সেই শাল কাঠ আনতে এখন অনেক দূরে যেতে হচ্ছে মেদিনীপুর, খড়্গপুর, রূপনারায়ণ ও ঝাড়গ্রামের মহিলাদের।

    কারণ, গত তিন দশকে পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলায় ৭৫ হাজার হেক্টরের বেশি ঘন শালজঙ্গল হারিয়ে গিয়েছে— এমনই উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে এক গবেষণায়।

    রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা কলেজের ভূগোল বিভাগের শিক্ষক প্রভাত কুমার সিটের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত গবেষণায় উঠে আসে, ১৯৯২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এই দুই জেলায় ঘন শাল বনভূমির পরিমাণ কমেছে ৭৫০২৯ হেক্টর।

    বর্তমানে শাল বনভূমির মোট পরিমাণ ২,০৪,২২০ হেক্টর। এই বন উজাড়ের ফলে ০.০৩৮ গিগা টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ বেড়েছে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

    উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ ও মাঠ পর্যায়ের সমীক্ষার মাধ্যমে মেদিনীপুর, খড়্গপুর, রূপনারায়ণ ও ঝাড়গ্রাম বনবিভাগে বনভূমির ঘনত্ব, স্বাস্থ্য ও স্থানীয়দের নির্ভরশীলতা খতিয়ে দেখেন গবেষকরা।

    তাঁরা জানান, একটি পূর্ণবয়স্ক ২০-২৫ বছর বয়সী শালগাছ বছরে গড়ে ১ লক্ষ লিটার অক্সিজেন দেয়। যার দৈনিক হিসেব প্রায় ২৭৪ লিটার। অথচ বন দপ্তরের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে শালজঙ্গলের জায়গায় লাগানো হচ্ছে ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি, সোনাঝুরির মতো বিভিন্ন গাছ।

    যেগুলি বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর। এই পরিস্থিতির সরাসরি প্রভাব পড়ছে আদিবাসী জনজাতিদের জীবিকায়। গবেষণায় বলা হয়েছে, শালপাতা, কেন্দুপাতা, মহুল, ছাতু ও জ্বালানির কাঠ সংগ্রহ করে বহু পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে।

    বন উজাড় হওয়ায় তাঁদের জীবনধারায় টান পড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দা চিন্তামণি মুর্মু বলেন, ‘শালপাতা আর জ্বালানির জন্য আগের চেয়ে অনেক দূরে যেতে হচ্ছে। আকাশমনির বাগান আমাদের কোনও উপকারে আসে না।’

    শুধু বন উজাড়ই নয়, যৌথ বন ব্যবস্থাপনা কমিটিতে (জয়েন ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটি) মহিলাদের অংশগ্রহণও কম। বন বাঁচাতে মহিলাদের অংশগ্রহণও প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষক।

    গবেষক দলের প্রধান শিক্ষক প্রভাতকুমার সিট বলেন, ‘ফরেস্ট প্রটেকশন অ্যাক্টে রয়েছে বন সুরক্ষা কমিটিগুলিতে মহিলাদের ৩৩ শতাংশ অংশগ্রহণ থাকা বাধ্যতামূলক। তা মানা হচ্ছে না।

    মহিলাদের অংশগ্রহণ বেশি থাকলে, জঙ্গল থেকে উপার্জন কত হচ্ছে, তাঁরা কত পাচ্ছেন, জঙ্গলকে বাঁচিয়ে রাখলে তাঁদের কী লাভ— সব জানতে পারবেন। মহিলারাই জঙ্গলে বেশি সময় কাটান। তাই জঙ্গল রক্ষার ব্যাপারে তাঁদেরই বেশি সচেতন করা প্রয়োজন। এমন নানা কারণেই ফরেস্ট প্রোটেকশন কমিটিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ বেশি প্রয়োজন।’

    গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ঝাড়গ্রাম বনবিভাগে মহিলাদের অংশগ্রহণ মাত্র ৬ শতাংশ, রূপনারায়ণ বিভাগে ৩.৮৭ শতাংশ, খড়গপুরে ৫.১৮ শতাংশ এবং মেদিনীপুরে ৫.৫ শতাংশ।

    সব মিলিয়ে ২৫৮ জন কমিটি সদস্যের মধ্যে ৯৪.৭৮ শতাংশ পুরুষ এবং সভায় মহিলাদের নিয়মিত উপস্থিতি মাত্র ৩.১৩ শতাংশ। শিক্ষক প্রভাত সিট বলেন, ‘জঙ্গলের সঙ্গে আদিবাসী সমাজের সম্পর্ক শুধু পরিবেশগত নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিকও।

    বনকে একটি সামাজিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। মহিলারা বন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন, যদি তাঁদের উপযুক্ত ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়।’

    গবেষক সৌমেন বিষুইয়ের মতে, ‘বন ব্যবস্থাপনায় বিকেন্দ্রীকরণ ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ জরুরি। নারী ও পুরুষ উভয়েই যেন বাস্তব সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সেই ব্যবস্থাই টেকসই রক্ষা আনবে।’

    খড়গপুর ডিভিশনের ডিএফও মনীশ যাদব জানান, পুরোনো কমিটিতে মহিলা অংশগ্রহণ কম থাকলেও বর্তমানে নতুন কমিটি গঠনে নিয়ম মেনে মহিলা সদস্য রাখা হচ্ছে। তাঁদের আরও বেশি করে উৎসাহিত করা হচ্ছে বন সুরক্ষায় অংশ নিতে।

    এই গবেষণা শুধু বন উজাড় নয়, তার সঙ্গে জড়িত বাস্তুতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন ও আদিবাসী জীবিকার টেকসই রক্ষার প্রশ্নও একইসঙ্গে তুলে ধরে যা নীতিনির্ধারকদের জন্য এক বড় বার্তা।

  • Link to this news (এই সময়)