দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বাঁকুড়া
ভনভন করে তারা দল বেঁধে উড়ে আসে। শরীরে ছেয়ে যায় নিমেষে। শুরু হয় হুল বেঁধানো। সে অসহ্য এক জ্বালা আর যন্ত্রণা!
তিনি কি অনুভব করেন? এক কাপ গরম চায়েই ভুলে যান সমস্ত যন্ত্রণা। দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে মৌমাছিদের সঙ্গে এমনই অম্ল-মধুর সম্পর্ক নিয়ে চলছেন সুখ মহম্মদ দালাল! এক-দু’শো কামড় তো হামেশাই খেতে হয়। এ পর্যন্ত একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৫০০ মৌমাছির কামড় হজম করেছেন!
বাঁকুড়ার ওন্দা ব্লকের চিঙ্গানি গ্রামের বাসিন্দা সুখ মহম্মদ। গত ২১ বছর ধরে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন। কিন্তু হুল-দংশন শুরু হয়েছিল কী ভাবে?
বছর ৩৮-এর সুখ মহম্মদ বলেন, ‘গ্রামের স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলাম। ১৭ বছর বয়সে কলকাতায় গিয়ে এক আয়ুর্বেদিক ডাক্তারের কাছে কাজ করতাম। মাসে পেতাম মাত্র ৭০০ টাকা।
দেখতাম, বিভিন্ন গাছ-গাছড়ার পাশাপাশি মধু দিয়েও আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি হয়। গ্রাম থেকে অনেকে মধু এনে ডাক্তারবাবুর কাছে বিক্রি করছে ভালো দামে। মনে হলো, আমাদের এলাকাতেও জঙ্গল ও লোকালয়ে মৌচাকের অভাব নেই।
চাক ভেঙে মধু বিক্রি করতে পারলে বেশি টাকা রোজগার করা যাবে। সেই কাজ ছেড়ে গ্রামে ফিরে মৌচাক ভাঙার কাজে নেমে পড়ি।’
গ্রামের একজনের থেকে পাঠ নিয়ে নিজের মতো কাজ শুরু করেন সুখ। মৌচাক ভাঙায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে ধীরে ধীরে নামও ছড়িয়ে পড়ে। কখনও গেঞ্জি পরে, কোথাও আবার খালি গায়ে আস্ত মৌচাক ভেঙে ফেলা, কখনও আবার মৌচাকের মধ্যে মাথা গলিয়ে দিয়ে ছবিও তোলেন।
মৌমাছির দল কামড় দিলে শরীর থেকে হুল বের করে এক কাপ গরম চায়ে চুমুক দিলেই গায়েব জ্বালা-যন্ত্রণা।
সুখ মহম্মদ বলছিলেন, ‘বছর আটেক আগে বিষ্ণুপুরের বাঁকাদহ এলাকা থেকে ডাক পড়েছিল তিনটি চাক ভাঙার জন্য। চাকগুলো ভাঙার সময়ে প্রচুর কামড় সহ্য করতে হয়েছিল। শরীর থেকে বেরিয়েছিল প্রায় ৪০০টি হুল।’
কথায় কথায় বলে ফেললেন, ‘এক মাস আগে ঝাড়খণ্ড থেকে ডাক এসেছিল মৌচাক ভাঙার জন্য। দিন তিনেক সেখানে থেকে প্রায় ৫০টি চাক ভাঙি। বটগাছে থাকা বেশ কিছু চাক ভাঙার কাজ করার সময়ে প্রায় ৫০০ মৌমাছি ঝাঁক বেঁধে এসে আক্রমণ করে। হুল ফুটিয়ে দেয় শরীরে।
ওই অবস্থায় গাছের উপরেই বসে থাকি। ধোঁয়া দিয়ে ওদের আক্রমণ প্রতিরোধ করি। পরে আবারও চাক ভেঙে মধু সংগ্রহ করি। বাজারে গিয়ে গরম চা খেয়ে হুলগুলো বের করে ফেলি।’
সংযোজন, ‘ছোটবেলায় মৌমাছি কামড়ালে মা গরম চা বানিয়ে দিতেন। আজও চাক ভাঙার পরে সেটাই খাই।’
১৯ বছর হলো বিয়ে হয়েছে সুখ মহম্মদের। স্ত্রী রাফিয়া বিবি বলেন, ‘শুরুর দিকে খুব ভয় হতো। এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, ভয় লাগে না।’ সুখ বলে যান, ‘এ পর্যন্ত একসঙ্গে প্রায় ৫০০ মৌমাছির কামড় খেয়েছি। ইচ্ছা আছে আগামী দিনে সংখ্যা বাড়িয়ে গিনেস বুকে নাম তোলার।’
২০১১ সালে সরকারি দপ্তর থেকে ঋণ নিয়ে ছোটখাটো মেশিন কিনেছেন তিনি। মধু সংগ্রহ করে তা পরিশোধন করে বোতলে ভরে বিক্রি করেন বাজারে। তার জন্য গ্রামে একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করা হয়েছে। আয় মন্দ হয় না। হুলবিদ্ধ হওয়ায় যে এত সুখ, তা কী আগে কেউ জানতেন!