বিতর্ক এড়ানো গেল না কসবায় নির্যাতিতা তরুণীর মেডিক্যাল টেস্ট নিয়েও। আরজি করে ধর্ষিতা ও নিহত তরুণীর মেডিক্যাল টেস্ট নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।
কসবার ক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠল, কেন ফরেন্সিক পরীক্ষা দেরিতে হলো, তা নিয়ে। দেরিতে মেডিক্যাল টেস্ট হওয়ার ফলে প্রমাণ নষ্টের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, এমন দাবি করা হচ্ছে।
খোদ সরকারি চিকিৎসকদের একটি সংগঠনের তরফেই অভিযোগ তোলা হয়েছে, কসবার নির্যাতিতার মেডিক্যাল টেস্ট কোনও সিনিয়র ফ্যাকাল্টিকে (শিক্ষক–চিকিৎসক) দিয়ে নয়, বৃহস্পতিবার রাতে পার্ক সার্কাসের ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে করানো হয়েছে তুলনায় জুনিয়র ডাক্তার, সদ্য স্নাতকোত্তর পাশ করা এবং সে দিন হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে ডিউটিরত এক জন সিনিয়র রেসিডেন্টকে (স্নাতকোত্তর পাশ বলে সিনিয়র, স্নাতকোত্তর পড়ুয়া হলে জুনিয়র রেসিডেন্ট) দিয়ে।
সেখানকার কর্তারাও সেই অভিযোগ অস্বীকার করেননি। বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশের মতে, ওটা ঠিকঠাক মেডিক্যাল টেস্ট-ই হয়নি। তাই, ক্রাইম সিন রিকনস্ট্রাকশনের পর শনিবার রাতে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের এক সিনিয়র ফ্যাকাল্টিকে দিয়ে কলকাতা পুলিশ ফের নির্যাতিতা ও অভিযুক্তদের মেডিক্যাল টেস্ট করিয়েছে।
যদিও যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে মেডিকো-লিগ্যাল টেস্ট সংক্রান্ত গাইডলাইন বলছে, এমন মেডিক্যাল টেস্ট করার জন্য খুব সিনিয়র কোনও ফ্যাকাল্টি না–হলেও চলে। সেখানে বলা হয়েছে, ওই চিকিৎসকের এমবিবিএস ডিগ্রি থাকলেই যথেষ্ট।
কিন্তু ফরেন্সিক মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একাংশের বক্তব্য, এই গাইডলাইন গোটা দেশের যে কোনও প্রত্যন্ত এলাকার কথা মাথায় রেখে তৈরি। কিন্তু খাস কলকাতায় একটি মেডিক্যাল কলেজে যখন সেই মেডিক্যাল টেস্ট হচ্ছে, তখন সিনিয়র ফ্যাকাল্টির উপস্থিতি কোনও অন্তরায় হতে পারে না। অথচ বাস্তবে কসবার নির্যাতিতার ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।
সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন, সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাসের বক্তব্য, ‘সরকারের কতটা গা-ছাড়া মনোভাব থাকলে, এমন সংবেদনশীল একটি মামলার মেডিক্যাল টেস্ট একজন সিনিয়র রেসিডেন্টকে দিয়ে করানো হয়! ন্যাশনালের মতো একটা পুরোনো মেডিক্যাল কলেজে কি সিনিয়র ফ্যাকাল্টি নেই? এত দায়সারা ভাবে কেন করা হলো নির্যাতিতার মেডিক্যাল টেস্ট?’
ফরেন্সিক মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনেকের অভিযোগ আবার আরও গুরুতর। কলকাতারই এক ফরেন্সিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘বিষয়টা শুধু সিনিয়র-জুনিয়রের নয়, বিষয়টা দক্ষতারও। এই কাজ সব চেয়ে ভালো করতে পারেন ফরেন্সিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞরাই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সুযোগ থাকলেও তার সদ্ব্যবহার করা হয়নি।’
ওই চিকিৎসকের মতে, যেহেতু এ ক্ষেত্রে নির্যাতিতার বয়স ১৮ বছরের বেশি, তাই মহিলা চিকিৎসককে দিয়েই মেডিক্যাল টেস্ট করানোর বাধ্যবাধকতা ছিল না। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগে চার জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন।
প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ডেমনস্ট্রেটর এবং এমডি পাশ করা সিনিয়র রেসিডেন্ট। তাঁর প্রশ্ন, ‘এঁদের চার জনের কাউকে দিয়ে কি নির্যাতিতার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো যেত না? কেন এ ভাবে অবহেলা করা হলো, যেখানে দেরির জন্য ধর্ষণের প্রচুর প্রমাণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সুযোগ ও আশঙ্কা রয়েছে!’
ওই চিকিৎসক জানান, এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই শনিবার রাতে কলকাতা পুলিশ নির্যাতিতা ও অভিযুক্তদের মেডিক্যাল টেস্ট করায় কলকাতা মেডিক্যালের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগে।
সেখানে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যথাসম্ভব নিখুঁত ভাবে নির্যাতিতা ও অভিযুক্তদের রক্ত, সোয়াব ও জামা-কাপড়ের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তাঁর আক্ষেপ, ‘এই কাজটাই অন্তত ৪৮ ঘণ্টা আগে স্বচ্ছন্দে করা যেতে পারত। তা হলে অনেক জোরালো প্রমাণ মিলতো।’
আর এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আবার পদ্ধতিগত ত্রুটির কথাও তুলে ধরছেন। বহু খুন, ধর্ষণের ঘটনায় অ্যাকিউজ়ড ও ভিক্টিমের স্বাস্থ্য পরীক্ষার অভিজ্ঞতা থাকা প্রবীণ ওই ফরেন্সিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞের মতে, বৃহস্পতিবার রাতে ন্যাশনালে হওয়া ওই মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট থেকে ধর্ষণের মামলা জোরালো ভাবে দাঁড় করানোর খুব অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাবে না।
ওই বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, ন্যাশনাল মেডিক্যালে নির্যাতিতার যে মেডিক্যাল টেস্ট করা হয়েছিল, তা আদৌ মেডিকো-লিগ্যাল টেস্ট ছিল না— বড়জোর তাকে ‘ইনজুরি রিপোর্ট টেস্ট’ বলা যেতে পারে। তাঁর কথায়, ‘আইন ও সরকারি বিধি বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর (এসওপি) মেনে মেডিকো-লিগ্যাল টেস্ট করতে হলে একটি নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করতে হয়।
বৃহস্পতিবার ন্যাশনালে তা করা হয়নি। যদি সেটা করা হতো, তা হলে ওই রিপোর্টেই উল্লেখ থাকত যে, নির্যাতিতার শরীরের কোন কোন অংশ থেকে সোয়াব–নমুনা নেওয়া হয়েছিল।
কারণ, ন্যাশনালে করা সেই টেস্টের রিপোর্ট বলছে, এ ক্ষেত্রে নির্যাতিতার যৌনাঙ্গ থেকে এমন কোনও নমুনা (ভ্যাজাইনাল স্মিয়ার) সংগ্রহই করা হয়নি, যা থেকে ধর্ষণে অভিযুক্তর শুক্রাণুর অস্তিত্ব মিলতে পারে।’