এই সময়: নির্যাতিতা ছাত্রীর যা বয়ান, তার সঙ্গে তদন্তে এখনও পর্যন্ত তাদের জানতে পারা ঘটনা পরম্পরা মিলে যাচ্ছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।
সেই সঙ্গে পুলিশ সূত্রে দাবি, তাদের হাতে আসা সাড়ে সাত ঘণ্টার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজের সঙ্গে মিল রয়েছে দক্ষিণ কলকাতার একটি আইন কলেজে গণধর্ষিতা ওই ছাত্রীর বয়ানের। কিন্তু তদন্তকারীদের একাংশ তাজ্জব প্রধান অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্রের ‘কনফিডেন্স’-এর কথা জেনে।
সূত্রের খবর, গত ২৫ জুন, বুধবার রাতে গণধর্ষণের ঘটনার কিছু পরে, রাত ১১টা নাগাদ কলেজ ছাড়ে প্রধান অভিযুক্ত মনোজিৎ এবং তার দুই শাগরেদ জ়ইব আহমেদ এবং প্রমিত মুখোপাধ্যায়।
প্রশ্ন উঠেছে, তার পর থেকে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে অ্যারেস্ট হওয়ার আগে পর্যন্ত কী করছিল তিন অভিযুক্ত? পুলিশ তিন জনকেই তাদের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করেছে। অর্থাৎ, তারা কেউ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাই করেনি। আগেই জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার মনোজিৎ কলেজে যায়নি। ফোনও বিশেষ ধরেনি। একবারই একজনের ফোন ধরে সে বলে, ‘আমার সঙ্গে খুব খারাপ হয়েছে।’
প্রশ্ন উঠেছে, এত বড় ঘটনা ঘটানোর পরে মনোজিৎ এবং অন্য দু’জন কেন গা ঢাকা দিল না?
সূত্রের খবর, মনোজিৎ-ই তার দুই শাগরেদকে বলে বাড়ি ফিরে যেতে। জানায়, চিন্তা না-করতে, সে সব সামলে নেবে। নিজের আস্তানায় ফিরে মনোজিৎ তার কয়েক জন আশ্রয়দাতা দাদা বা ‘মেন্টর’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বলে তার ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা গিয়েছে।
ওই ‘দাদা’দের কাছে তার অনুরোধ ছিল, ‘দেখো, যেন এফআইআর না-হয়!’ পুলিশ জেনেছে, এর আগেও মনোজিৎ অপরাধ করার পর তাকে পুলিশের হাত থেকে এই ‘দাদা’রাই বাঁচিয়েছিলেন।
মনোজিৎ সম্ভবত ভেবেছিল, এ বারও তা–ই হবে, এফআইআর-ও হবে না, এমনকী হলেও তাকে কেউ ছুঁতে পারবে না। ফলে সে থেকে যায় নিজের ঠিকানাতেই এবং বাকি দু’জনকেও সেটাই করতে বলে— এমনটাই তদন্তে উঠে এসেছে।
তদন্তকারীদের হাতে আসা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গিয়েছে, রাতে আতঙ্কিত অবস্থায় গেটের কাছে আসছেন নির্যাতিতা। গেটে তালা দেখে তিনি অসহায় হয়ে পড়ছেন। তখন দুই অভিযুক্ত তাঁকে জোর করে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে গার্ড-রুমের দিকে। এ সবই নির্যাতিতা এফআইআরে উল্লেখ করেছেন।
রবিবার নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁদের পাওয়া যায়নি। তাঁরা কোথায় আছেন, তা-ও স্পষ্ট করে জানা সম্ভব হয়নি। তবে রবিবারই প্রকাশ্যে এসেছে নির্যাতিতা ছাত্রীর পরিবারের একজনের একটি ভিডিয়ো-বার্তা (যার সত্যতা যাচাই করেনি ‘এই সময়’)।
সেখানে এক ব্যক্তি দাবি করছেন, ‘আমরা কলকাতা পুলিশের উপর আস্থা রাখছি। সিবিআই তদন্ত চাই না। ন্যাশনাল উইমেন্স কমিশন থেকেও আমাদের ফোন করেছিল, তাদেরও আমরা সব জানিয়েছি।’
বিজেপি ইতিমধ্যেই দাবি করেছে যে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে ওই নির্যাতিতার পরিবারকে। সেই দাবিকেও নস্যাৎ করে ওই ব্যক্তিকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, আমাদের উপরে কোনও হুমকি আসবে না। আমরা এর শেষ দেখে ছাড়ব।’ ওই ব্যক্তি নির্যাতিতার কে হন, সে বিষয়ে অবশ্য কোনও তথ্য মেলেনি।
গণধর্ষণে মনোজিৎ গ্রেপ্তার হওয়া ইস্তকই তার নানা কীর্তি সামনে আসছে। সূত্রের খবর, ওই আইন কলেজ যে এলাকায়, সেখানকার পেয়িং গেস্ট (পিজি) হস্টেলগুলোর সঙ্গে তার একটা আঁতাঁত ছিল। কলেজে ভর্তি হওয়া প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের জন্য উপযাচক হয়ে পিজি খুঁজে দিত সে।
তাঁদের প্রলোভন দিত, অল্প টাকায় থাকার ভালো ব্যবস্থা সে করে দেবে। ওই ফাঁদে যাঁরা পা দিতেন, অতিষ্ঠ হতো তাঁদের অনেকেরই জীবন। অনেকেই সেই পিজি হস্টেল তো বটেই, এমনকী কলেজ পর্যন্ত ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। এমনই এক ছাত্রীর কথায়, ‘ওই সব পেয়িং গেস্ট হস্টেল ছিল ওর (মনোজিৎ) শিকার ধরার জায়গা।
ওই এলাকার পিজি-গুলোয় ছাত্রী ভর্তি করিয়ে সেখান থেকে টাকা তোলার পাশাপাশি মনোজিৎ সেখানে যখন-তখন ঢোকার কার্যত লাইসেন্স নিয়ে রেখেছিল। আমার রুমমেট এবং আমি কলেজে ক্লাস করে হস্টেলে গিয়েই মনোজিতের ভয়ে রুম বন্ধ করে রাখতাম। কিন্তু গভীর রাতেও মনোজিৎ রুমে ঢুকতে চেয়েছে।’ ওই ছাত্রী পরে তাঁর আত্মীয়ের ফ্ল্যাটে চলে যান।
নির্যাতিতা ছাত্রী এফআইআরে তাঁর বয়ানে লিখেছেন, প্রথম বার ইউনিয়ন রুমের মধ্যে যখন তাঁকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়, তখন তাঁর প্যানিক অ্যাটাক হয়, তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। রুবি হাসপাতালে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অভিযুক্তদের তিনি অনুরোধ করেন।
নিদেনপক্ষে একটা ইনহেলার এনে দিতে কাতর অনুরোধ জানান তিনি। ওই ছাত্রীর বয়ান অনুযায়ী, অভিযুক্ত ‘এম’ তখন ইনহেলার এনে দেয়। সে কোথা থেকে ইনহেলার এনেছিল? সেই দোকানটি কোথায়? সেখানে কি কোনও সিসিটিভি ক্যামেরা এবং তার ফুটেজ রয়েছে?
দোকানদারের সঙ্গে কি যোগাযোগ করেছিল পুলিশ? তদন্তকারীদের একাংশ জানাচ্ছেন, দোকানটি চিহ্নিত করা গিয়েছে। কলেজেরই কাছে, কসবার বড় একটি ওষুধের দোকান থেকে তা কিনে আনে ‘এম’। পুলিশ সূত্রে দাবি, এই ‘এম’ কিন্তু মনোজিৎ নয়, ‘এম’ আসলে জ়ইব। ওই দোকানের কর্মীদের বয়ান, প্রয়োজনীয় ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ।
নির্যাতিতা ছাত্রীর বয়ানে জানা গিয়েছিল, ঘটনার দিন অন্তত সন্ধে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ‘সব কিছু ঠিক ছিল’। আরও অনেক ছাত্রছাত্রী ছিলেন সেখানে। কলেজের জেনারেল সেক্রেটরির কথাও নির্যাতিতা তাঁর বয়ানে লিখেছেন, যাঁর সঙ্গে তিনি অনেকক্ষণ ছিলেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, ওই জেনারেল সেক্রেটরি-সহ মোট ২৫ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছেন তদন্তকারীরা। সেই তালিকা ধরে সবাইকে ডাকা হবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।
ওই তালিকায় ছাত্রী, প্রাক্তনী, নিরাপত্তারক্ষী-সহ আরও কয়েক জন আছেন বলে সূত্রের খবর। আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, নির্যাতিতার মা–বাবার গোপন জবানবন্দি নিতে চেয়েছে পুলিশ। এই মর্মে পুলিশের আবেদন আলিপুর আদালতের কাছে জমাও পড়েছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে ৯ করা হয়েছে। অভিযুক্তদের বাড়িতে শনিবার রাতে সিট তল্লাশি চালায়। বুধবার ঘটনার সময়ে তাদের পরা জামা, জুতো, মোজা ও অন্যান্য জিনিস সেখান থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
প্রধান অভিযুক্ত মনোজিতের মোবাইল ফোনে তোলা সে দিনের সেই ঘটনার ভিডিয়ো খতিয়ে দেখার জন্য সিট সেটিকে ডিজিটাল ফরেন্সিক অ্যানালিসিসের জন্য পাঠিয়েছে। ধৃতদের মোবাইল ফোন ও কল ডিটেল রেকর্ডও (সিডিআর) খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই ঘটনার পিছনে দীর্ঘ পরিকল্পনা রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছেন সিট-এর সদস্যরা।
রবিবার সকালে ন্যাশনাল উইমেন্স কমিশনের সদস্যরা দক্ষিণ কলকাতার ওই আইন কলেজে যান। তার পরেই সেখানে খানিকটা ঘোরালো হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। পুলিশের বিরুদ্ধে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তোলেন কমিশনের সদস্য অর্চনা মজুমদার।
কমিশনের চার জন সদস্যকে পুলিশ প্রাথমিক ভাবে বাধা দেয় বলে অভিযোগ ওঠে। পরে অবশ্য তিন জনকে কলেজের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়। অর্চনা বলেন, ‘আমরা সব ঘুরে দেখেছি। কিন্তু সব কিছুই বন্ধ ছিল। আমাদের মনে হয়েছে, পুলিশ কিছু একটা লুকোনোর চেষ্টা করেছে।’ তৃণমূল পাল্টা অর্চনার বিজেপি-পরিচয় নিয়ে কটাক্ষ করেছে।
এফআইআরে উল্লেখ থাকা ‘এম’, ‘জে’, ‘পি’— অভিযুক্তদের প্রত্যেকের পরিচয় একটি করে ইংরেজি অক্ষরের মাধ্যমে জানানো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপির প্রশ্ন, এফআইআরে মনোজিৎ মিশ্রর জন্য ‘জে’, জ়ইব আহমেদের জন্য ‘এম’ এবং প্রমিত মুখোপাধ্যায়ের জন্য ‘পি’ ব্যবহার করা হয়েছে।
এটা কি রাজ্যের শাসকদল এবং কলকাতা পুলিশের পরিকল্পিত চক্রান্ত? যেখানে ‘এম’ স্বাভাবিক ভাবে মনোজিৎকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করার কথা, সেখানে জ়ইবের জন্য ওই অক্ষর কেন ব্যবহার করা হয়েছে? বিজেপির দাবি, মামলাকে দুর্বল করতে এবং অভিযুক্তদের ছাড় দিতে এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে করা হয়েছে।
তবে এ নিয়ে পুলিশের ব্যাখ্যা, ২০১৯–এ সুপ্রিম কোর্টে একটি জাজমেন্টের পর থেকে এ ধরনের ঘটনায় দু’টি এফআইআর হয়। মূল কপি— যেটিতে নির্যাতিতার নাম পরিচয় থাকে, সেটি বিচারকের কাছে খামবন্ধ অবস্থায় জমা দেওয়া হয়।
আর দ্বিতীয় এফআইআর কপি, যা পাবলিক ডোমেনে দেখা যায়, সেটিতে নাম, পরিচয় আগে লেখা হলেও পরে তা মুছে ফেলতে ব্যবহার করা হয় হোয়াইটনার। যাতে নির্যাতিতার নাম, পরিচয় গোপন থাকে। সেখানেই অভিযুক্তদের নামের জায়গায় ‘অ্যালফাবেট’ ব্যবহার করা হয়। তার পরেও প্রশ্ন, তা হলে মনোজিতের নামের জায়গায় ‘এম’ না-লিখে কেন ‘জে’ লেখা হয়েছে?