পলাশির প্রান্তরে হয়ে গেল ভোটের যুদ্ধ। শাসক দল সেখানে প্রত্যাশিত জয় পেলেও শতাংশের বিচারে ভোট ক্ষয় হল প্রধান বিরোধী দল বিজেপির। সাম্প্রতিক ১০টা বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের তুলনায় বেশ খানিকটা ভোট-শতাংশ বাড়ল তৃতীয় পক্ষের। তবু সমঝোতার প্রশ্নে ‘নবাবি মনোভাব’ কাটার লক্ষণ নেই তৃতীয় শিবিরের!
রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আর গোটা এক বছরও বাকি নেই। কিন্তু বাম ও কংগ্রেসের সমন্বয়ের কোনও প্রক্রিয়াই এখনও গতি পায়নি। কে কার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করবে, কে কী ভাবে কাকে প্রস্তাব দেবে, এই টানাটানিতেই সময় কাটিয়ে চলেছে দুই শিবির। এমনকি, সূত্রের খবর, কালীগঞ্জে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করে উপনির্বাচনে লড়াই করে তুলনামূলক ভাবে উন্নতি করলেও ফল ঘোষণার পরের দু’দিন সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠকে জোট-প্রসঙ্গ আলোচনাতেই আসেনি! বাম এবং কংগ্রেস দুই শিবিরের অন্দরেই চর্চা চলছে, সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির অকাল প্রয়াণ দু’পক্ষের সমঝোতার প্রক্রিয়াকে অন্তত আঠারো বাঁও জলে ফেলে দিয়েছে! নিরন্তর দিল্লির কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ইয়েচুরি যে ভূমিকা পালন করতেন, সেই দক্ষতা ও ইচ্ছা এখন অমিল।
প্রশ্নের মুখে রাজ্য সিপিএম এবং প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব, উভয়েই বলছেন, ‘‘আমরা তো দরজা বন্ধ করিনি! নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনেই নির্বাচনী কৌশলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’’ কিন্তু কাজে কী হচ্ছে? বাম সূত্রের খবর, গত ফেব্রুয়ারি মাসে সিপিএম বামফ্রন্টের সব শরিক দলের কাছে ‘বাস্তবভিত্তিক’ আসনের দাবির তালিকা চেয়েছিল। যাতে আসন বণ্টনে ভোটের অনেক আগে থেকেই সিদ্ধান্তের দিকে এগোনো যায় এবং কংগ্রেসের জন্য জায়গা বার করার পথও খোলা যায়। তার পরে সেই প্রক্রিয়া আর এগোয়নি। এখন ঠিক হয়েছে, জুলাইয়ে শরিকদের সঙ্গে আসন-তালিকা নিয়ে ফের আলোচনা হতে পারে। এর মাঝে কালীগঞ্জ উপনির্বাচনে আসনের দাবি নিয়ে সিপিএম, এবং শরিক আরএসপি-র মধ্যে এক প্রস্ত টানাপড়েন হয়ে গিয়েছে, শেষ পর্যন্ত আসন ছাড়া হয়েছে কংগ্রেসকে।
এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক এবং পর্যবেক্ষক গুলাম আহমেদ মীরও কয়েক মাস আগে বিধান ভবনে কর্মশালায় এসে পরামর্শ দিয়েছিলেন, লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে অন্তত ৯০টি আসন বেছে নিয়ে সাংগঠনিক প্রস্তুতি শুরু করুক প্রদেশ কংগ্রেস। তাতেই বার্তা উঠে এসেছিল, সব আসনে লড়ার মতো সাংগঠনিক ক্ষমতা নেই বুঝেই কেন্দ্র বেছে নিয়ে জোর দিতে বলা হচ্ছে এবং জোটের দরজাও খোলা থাকছে। লোকসভা নির্বাচনের পরিসংখ্যানও বলে দিচ্ছে, সমঝোতা ছাড়া বিধানসভায় শূন্যের গেরো কাটানো এখনও বাম ও কংগ্রেসের কাছে কার্যত ‘দুরাশা’! লোকসভা ভোটের নিরিখে গোটা রাজ্যে মাত্র একটি বিধানসভা কেন্দ্রে (মুর্শিদাবাদের রানিনগর) এগিয়ে সিপিএম। কংগ্রেস এগিয়ে উত্তর দিনাজপুর, মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলার ১১টি আসনে। এবং এই ১২ আসনেই দু’পক্ষের ভোট মিশে আছে। তার পরেও দুই শিবিরের বিলম্বিত লয় দু’পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের একাংশের হতাশা বাড়াচ্ছে।
কালীগঞ্জে উপনির্বাচনেএকসঙ্গে লড়ার পরেও শাসক দলের বোমায় মোলান্দি গ্রামের বালিকা তামান্না খাতুনের হত্যা সিপিএম ও কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্বকে এক মঞ্চে আনতে পারেনি! তামান্নার শেষকৃত্যে হাজির ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার, সিপিএমের রাজ্য নেতারা তখন যাননি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম যখন কালীগঞ্জের পলাশিতে প্রতিবাদ-সভা করতে গিয়েছেন, প্রদেশ কংগ্রেসকে আমন্ত্রণ করা হয়নি। সিপিএমের রাজ্য কমিটির এক নেতার বক্তব্য, ‘‘ভোটে এক বার করে সমঝোতা হচ্ছে আবার সব থিতিয়ে যাচ্ছে, এটা জনমানসে ভাল বার্তা দেয় না। এত দিনে দু’পক্ষের সমন্বয় কমিটি গড়ে একটা প্রক্রিয়ায় আসা উচিত ছিল।’’
এর আগে রাজ্যে ২০১৬ ও ২০২১ সালের বিধানসভা এবং ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বামেদের সঙ্গে সমঝোতার সময়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন অধীর চৌধুরী। সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ এখনও অধীরের সঙ্গে যোগাযোগে ‘স্বচ্ছন্দ’, তাতে জটিলতা আরও বাড়ছে। কংগ্রেসের অন্দরের খবর, এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) কে সি বেণুগোপাল নিজে কেরলে কংগ্রেসের সরকার গঠনে বেশি উৎসাহী বলে বঙ্গে বামেদের সঙ্গে সমঝোতায় এগোতে তাঁদের সেই আগ্রহ নেই। কংগ্রেসের এক জেলা সভাপতির কথায়, ‘‘দু’পক্ষের বড় যৌথ কর্মসূচি চালু রেখে আসনের সমঝোতায় গেলে তার প্রভাব ভাল হয়। কিন্তু একসঙ্গে আন্দোলনই তো হচ্ছে না!’’