বিশ্বদেব ভট্টাচার্য, আসানসোল
ট্রায়াল রানেই পাথর ছোড়া হয়েছিল বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে (তখন, ট্রেন ১৮)। দিল্লি থেকে বারাণসী পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রথম বন্দে ভারত চালানো হয় ২০১৯-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি। তার দিন দশেক আগে দিল্লিতেই ট্রায়াল রানের সময়ে পাথরের আঘাতে ট্রেনটির কাচের জানলার ক্ষতি হয়।
সেই শুরু, তার পর থেকে বন্দে ভারত লক্ষ্য করে অসংখ্য পাথর ছোড়া হয়েছে। শুধু বন্দে ভারত নয়, বছরের পর বছর প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটে চলেছে। যা রুখতে এ বার কোমর বেঁধে প্রচারে নামছে রেল।
জানা গিয়েছে, পূর্ব রেলের হাওড়া, আসানসোল, শিয়ালদহ এবং মালদা— এই চার ডিভিশনে গত বছরে ট্রেনে পাথর ছোড়ার ১১০টি ঘটনা ঘটেছিল।
এ ব্যাপারে পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক দীপ্তিময় দত্ত বলেন, ‘২০২৪-এ ওই চার ডিভিশন থেকে ট্রেনে পাথর ছোড়ায় অভিযুক্ত ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। চলতি বছরে (২০২৫–এর ২৫ জুন পর্যন্ত) ইতিমধ্যেই এমন ৮৩টি ঘটনার খবর পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্যে ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
বোঝাই যাচ্ছে, ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা গত বছরের তুলনায় এ বছরে আনুপাতিক হারে বেড়েছে।
এই অবস্থায় রীতিমতো আতঙ্কে রেল কর্তৃপক্ষ। পাথরের আঘাতে যাত্রীদের রক্তাক্ত হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। রক্ষা পাচ্ছেন না রেলকর্মীরাও। এক দিকে যাত্রী সুরক্ষা, অন্য দিকে ট্রেনের লোকো পাইলট বা গার্ডদের সুরক্ষায় তাঁরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বলে জানান দীপ্তিময়।
মূলত সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ও প্রিমিয়াম ট্রেনগুলিকেই টার্গেট করে পাথর ছোড়ে দুষ্কৃতীরা। আসানসোল ডিভিশনের চিত্তরঞ্জনের পরে বেনা থেকে জামতাড়া ও জামতাড়া থেকে বিদ্যাসাগর স্টেশনের মধ্যে এই ধরনের ঘটনা একাধিক বার বিভিন্ন ট্রেনে ঘটেছে। জানা গিয়েছে, আরপিএফের তরফে ওই সব এলাকার গ্রামগুলিতে গিয়ে নিয়মিত প্রচার চালানো হচ্ছে।
আরপিএফের রেলওয়ে আইন ১৯৮৯–এর ১৫৩ ধারার অধীনে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও, অবস্থার যে পরিবর্তন হচ্ছে না তা রেলের দেওয়া পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট।
সে জন্য এ বিষয়ে প্রচারে নতুন করে জোর দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। যদি কেউ চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারে, তা হলে তাকে রেলওয়ে আইন ১৯৮৯–এর ১৫৩ ধারার অধীনে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে বলে আসানসোলের এক আরপিএফ আধিকারিক জানান। এই ধরনের ঘটনা চোখে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে রেলের হেল্পলাইন নম্বর ১৩৯-এ ফোন করে রিপোর্ট করার আবেদন জানাচ্ছে রেল।
একইসঙ্গে চলছে সচেতনতামূলক প্রচারও। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক জানান, ট্রেনে পাথর ছোড়ার প্রবণতা রুখতে শর্ট ফিল্ম দেখানো হচ্ছে। আলোচনা শিবির, পোস্টারের মাধ্যমেও সচেতন করা হচ্ছে মানুষকে।
২০২৪-এ স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, স্কুল শিক্ষক এবং সামাজিক গোষ্ঠীর সহযোগিতায় ১,৭১৮টি সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হয়েছিল। এ বছর প্রথম ছয় মাসে ১,০৫৯টি সচেতনতামূলক অভিযান চালানো হয়েছে।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এই বিপজ্জনক অভ্যাস বন্ধ করতে অভিভাবকরা সন্তানদের সচেতন করতে পারেন, প্রয়োজনে স্কুলে এ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
অনেকে মনে করেন, নামীদামি ট্রেনগুলি কাছের স্টেশনে না-দাঁড়ানো বা সেগুলিতে চড়তে না-পারার ক্ষোভ থেকে সেগুলিতে পাথর ছোড়া হতে পারে। আবার রয়েছে মানসিক বিকৃতির কারণও।
যেমন, ২০২৪–এর ২ অক্টোবর বারাণসী থেকে দিল্লিগামী বন্দে ভারতে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটে উত্তরপ্রদেশের কানপুরের কাছে পনকী স্টেশনের কাছে। ওই ঘটনায় ধৃত এক যুবকের কাছে ট্রেনে পাথর ছোড়ার কারণ জানতে চেয়েছিলেন তদন্তকারীরা।
জবাবে ধৃত যুবক জানান, ট্রেনের জানলার কাচ ভাঙতে তাঁর ভালো লাগে। দ্রুত গতিতে ছুটে চলা ট্রেনকে থামিয়ে দিতে তাঁর মজা লাগে। অভিযুক্তের মুখে এ কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন তদন্তকারীরা।