নিত্যপ্রয়োজনে মানুষের ব্যবহৃত পানীয় জল জনজীবনে অজান্তেই ডেকে আনছে ভয়াবহ বিপদ। বিশেষত বাজার থেকে কেনা মিনারেল ওয়াটার জার থেকে অজান্তে বিপদের মেঘ ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে। মিনারেল ওয়াটার বলে বাজারে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন কোম্পানির জলের জার বা বোতলগুলি কতটা সুরক্ষিত এবং পানের যোগ্য তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। চিকিৎসকমহলে উৎকণ্ঠা এবং আতঙ্ক। ভাজ পড়ছে কপালে মানবজীবনের সুস্থতা নিয়ে।
প্রতিদিন বাজার থেকে ২০ লিটারের জলের জার আপনি এত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কিনছেন সেগুলিই রোগের মূল আঁতুড়ঘর বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। চিকিৎসকদের মতে, এই জলের জারগুলিতে রয়েছে এমন বহু ক্ষতিকারক রাসায়নিক যার ফলে উপকারের চেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে। এই জারগুলি তৈরি হয় পলিইথিলিন টেরেফথ্যালেট (PET) নামক একটি প্লাস্টিক উপাদান দিয়ে যা কয়েকবার ব্যবহারের পরেই জলে বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ ছড়াতে শুরু করে। আট-দশ বার ব্যবহারের পর এগুলি আর নিরাপদ থাকে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা এবং যা পরীক্ষামূলকভাবেও প্রমাণিত। দুঃখজনকভাবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই পুনর্ব্যবহারের সংখ্যা ট্র্যাক করার কোনও পদ্ধতি থাকে না। ফলে জারগুলি ততক্ষণ ব্যবহৃত হয় যতক্ষণ না তা ফেটে যায় বা দৃশ্যমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-র গাইডলাইন অনুযায়ী, পানীয় জলে 'টোটাল ডিসঅলভড সলিড' (TDS) এর মাত্রা ৩০০ পিপিএম-এর নীচে হওয়া উচিৎ। পানীয় জলের বাজারচলতি প্রসিদ্ধ প্রস্তুতকারক সংস্থার ৫০০ মিলি, এক, দুই, পাঁচ, দশ ও কুড়ি লিটারের বোতল বা জারে এর মাত্রা দেখা গিয়েছে ৮০-১২০ পিপিএম-এর মধ্যে থাকে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের রি-সাইকেল করা বোতলের 'জাল-জল' এবং অনামী সংস্থার জল এই গুণগত মানে ডাহা ফেল করে। ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (WTP) এবং বৈধ ছাড়পত্র ছাড়াই নাম ভাঁড়িয়ে বা জাল 'সিল' ব্যবহার করে 'ব্র্যান্ডেড বোতল'-এ দেদারে বিক্রি হচ্ছে 'জেনেরিক ভেজাল জল'। পরিশ্রুত জলে 'ক্লোরিনেশন' কম মাত্রায় বা বিপজ্জনক মাত্রায় চলে যাচ্ছে। এর ফলে আমাদের পাকস্থলী ও অন্ত্রনালীতে পরিপাকক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। ক্ষুধামন্দ, হজমের গন্ডগোল, অ্যাসিডিটি, পেটের গন্ডগোল, স্নায়ুতন্ত্রের উপরেও প্রভাব পড়ছে।
গভীর নলকূপের সমস্যা যেখানে রয়েছে সেখানে আমরা আর্সেনিকের বিষক্রিয়াও দেখেছি৷ তবে যে দু’টি খনিজ পদার্থ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হল ম্যাগনেশিয়াম ও পটাশিয়াম। তাই এগুলির মাত্রা সঠিক থাকা অত্যন্ত জরুরি। জলের পরিশ্রুতকরণের প্রত্যেকটি পরীক্ষা সঠিক নজরদারিতে করা প্রয়োজন। 'স্লো স্যান্ড ফিল্টার বেড' (জীবাণুরোধক), রিভার্স অসমোসিস (আরও), অতিবেগুনী রশ্মি দ্বারা শেষধাপের পরিশ্রুতকরণ অত্যন্ত জরুরী যা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসনিক নজরদারিতে করা উচিত। একই সঙ্গে এই সব জারগুলিতে থাকে না কোন 'এক্সপায়ারি ডেট', যার ফলে বিপদের ঝুঁকি থাকছেই। কারণ, বেশিদিন একটি অনুন্নত প্লাস্টিকের জারে জল সঞ্চিত থাকলে সেখানে অদৃশ্য বেশ কিছু ফাঙ্গাস বা ব্যাকটেরিয়া জন্ম নিতে পারে, যা মানুষের জীবনের জন্য অতীব ঝুঁকিপূর্ণ। এ জায়গায় 'ননসেন্স পোয়েট্রির' কালজয়ী স্রষ্টা সুকুমার রায়ের 'অবাক জলপান'-এর পথিকের মতো উদ্ধৃত করে বলাই যায়, ‘মশাই একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?’ FSSAI-র (ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা ও মান নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ) তথ্য অনুযায়ী, ৭৫% প্যাকেজিং ইউনিট FSSAI লাইসেন্স ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। বেশিরভাগ ২০ লিটারের জারগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কল থেকে সরাসরি ভরা হয়। মানা হয় না কোনও স্বাস্থ্য সচেতনতার বিধিনিষেধ। যা অনেকসময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সংগ্রহ করা হয় এবং এতে জলবাহিত রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি ৯৯% থেকে যায়।
অপরিশোধিত জল দেখতে স্বচ্ছ হলেও, তাতে থাকতে পারে নানা ধরনের ভয়ঙ্কর উপাদান:
১. ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস: E. coli এবং Legionella-এর মতো প্যাথোজেন শরীরে প্রবেশ করলে জ্বর ও সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। খারাপ স্যানিটেশন এবং পুরনো পাইপলাইনের মাধ্যমে এই জীবাণু জলে মিশে যেতে পারে। অপরিশোধিত জলে থাকা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবীরা শিশু, বৃদ্ধ এবং রোগপ্রবণদের জন্য মারাত্মক। ডায়রিয়া, টাইফয়েড, কলেরা এবং হেপাটাইটিস এ–এর মতো রোগ এসব জল থেকেই ছড়ায়।
২. ভারী ধাতু: আর্সেনিক, সিসা (lead), ও পারদের মতো ধাতু নিঃশব্দে শরীরে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করে। কিডনি, লিভার, শিশুদের বুদ্ধিবিকাশে সমস্যা এবং কিছু ক্ষেত্রে ক্যানসারও হতে পারে।
৩. রাসায়নিক অবশিষ্টাংশ: ক্লোরিন, কীটনাশক ও শিল্পবর্জ্যের কারণে জলের স্বাদ যেমন বদলে যায়, তেমনি এগুলি শরীরের হরমোন ভারসাম্য নষ্ট করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে তোলে।
৪. পাইপলাইনের মরিচা ও গাদ: পুরনো পাইপলাইন থেকে জল আসার সময় মরিচা ও অন্যান্য গাদ মিশে যেতে পারে, যা আপনার ফিল্টার, পানীয় জল, এমনকি রান্নার ক্ষেত্রেও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই বিষয়ে আমরা সরাসরি কথা বলেছিলাম চিকিৎসক তথা মন্ত্রী শশী পাঁজার সঙ্গে, তিনি বলেন, "বাজারে অনেক জলের সংস্থা রয়েছে, যারা দাবি করছে, তারাও মিনারেল ওয়াটার বানান। এক্ষেত্রে মানুষকে সচেতন হতে হবে, যাচাই করে দেখে নিতে হবে। প্রতিটি মানুষকে সচেতন থাকতে হবে এবং একই সঙ্গে সঠিক টাকেই চিনে নিতে হবে।“
মন্ত্রী আরও বলেন, "অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় দূষিত জল দিয়েই এ ধরনের পানীয় প্রস্তুত হয়। কখনও ড্রেনের জল পর্যন্ত ব্যবহৃত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন হতে হবে, জল কিনে খাওয়ার সময় নজর রাখতে হবে। প্রয়োজনে সেই ভেন্ডারের সঙ্গে কথা বলে জেনে নেওয়াটা অতীব জরুরি।“
এই বিষয়ে আজকাল ডট ইনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন আরও দুই চিকিৎসক সংযুক্তা দে এবং রঞ্জন ভট্টাচার্য। চিকিৎসক রঞ্জন বলেন, "পানীয় জলের বোতলের রমরমা বেড়েছে দেড় দশকে। একসময় আমরা মনে করতাম, 'জল কিনে খাওয়া' একটা বিলাসিতা, বড়লোকদের 'স্ট্যাটাস সিম্বল', এখন প্রত্যেক গার্হস্থ্য জীবনের অঙ্গাঙ্গী ভূমিকা পালন করে চলেছে এই মিনারেল ওয়াটার। একটি বহুজাতিক পানীয় জল প্রস্তুতকারক সংস্থার বাৎসরিক ব্যবসা প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার। ভূগর্ভস্থ জলের স্তর ক্রমান্বয়ে নীচে নামছে। আকাশছোঁয়া অট্টালিকার জলের চাহিদায় তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম দুর্ভোগ।"
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সংযুক্তা বলেন, "জল সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত বড় বড় ট্যাঙ্ক অনেক সময় নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। এর ফলে সেই জল যখন ক্যান ভরা হয়, তখন সেটি হয়ে পড়ে জীবাণুতে ভরা"। তিনি আরও বলেন, "প্লাস্টিকের এই ক্যানগুলি অনেক সময় এমন জায়গায় রাখা হয় যেখানে সরাসরি রোদ পড়ে এবং ধুলো জমে। আবার, পরিবহনের সময় এগুলি খোলা ট্রাকে নিয়ে যাওয়া হয়, ফলে আরও বেশি রোদ, ধুলো, এবং নোংরা পরিবেশে এক্সপোজড হয়। এতে করে বোতলের ভিতরে ও বাইরে ব্যাকটেরিয়ার জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।"