মিনাক্ষীর ঠিক-ভুল নিয়ে চর্চায় আড়াআড়ি বিভক্ত সিপিএম, এক লাফে কেন্দ্রীয় কমিটিতে গিয়েই কি ‘স্খলন’, প্রশ্ন দলেই
আনন্দবাজার | ৩০ জুন ২০২৫
ভরা ব্রিগেডে কবি নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা বলতে গিয়ে শব্দ গুলিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়েই কোনও চালাকি না-করে বা অজুহাত না-দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ভুলে গিয়েছি!’’ তা নিয়ে বিতর্ক হয়নি। বরং রাজনৈতিক মহলের অনেকে প্রশংসা করেছিলেন ভুল স্বীকারের দরাজ মানসিকতা দেখানোয়। দেড় বছরের ফারাকে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরই ‘কুকথা’ বিতর্ক তৈরি করেছে। তিনি সিপিএমের তরুণ নেত্রী মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, যা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত দল।
গত ২৩ জুন কালীগঞ্জের উপনির্বাচনের ফল ঘোষণার দিন তৃণমূলের বিজয়মিছিল থেকে ছোড়া বোমার আঘাতে মৃত্যু হয়েছিল সিপিএমের সমর্থক পরিবারের নাবালিকা তমন্না খাতুনের। গত শনিবার নদিয়ার পলাশী বাজারে তমন্না-হত্যার প্রতিবাদে সমাবেশ করে সিপিএম। সেই সভাতেই নাম না-করে তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষকে আক্রমণ করতে গিয়ে অপশব্দ ব্যবহার করেছেন মিনাক্ষী। কুলটির এই তরুণী সাধারণ ভাবে মেঠো ভাষায় বক্তৃতা করেন। বাংলা বলতে বলতে হঠাৎ সাবলীল হিন্দি বলেন। আবার ফিরে আসেন বাংলায়। যে কারণে বাম জনতার কাছে অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি। কিন্তু কখনও প্রকাশ্যে তাঁকে অপশব্দ ব্যবহার করতে শোনা যায়নি, যা ঘটেছে গত শনিবার। সেই সূত্রেই প্রশ্ন উঠছে, মিনাক্ষী কি ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ’ হারাচ্ছেন?
খুব বেশি দিন হয়নি তিনি দলের রাজ্য কমিটির সদস্য হয়েছেন। দলে তাঁর চেয়ে বর্ষীয়ানদের পিছনে ফেলে এ বার রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী এবং কেন্দ্রীয় কমিটিতেও জায়গা পেয়েছেন। সেই মিনাক্ষীর মুখে অপশব্দ শুনে দলের মধ্যে এই প্রশ্নও উঠছে যে, দ্রুতগতিতে কেন্দ্রীয় কমিটি এবং রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে উত্থানেই কি স্খলন হল সদ্য যুব সংগঠন থেকে বিদায় নেওয়া নেত্রীর। মাথা ঘুরে গিয়েছে তাঁর? হিতাহিত জ্ঞান থাকছে না?
মিনাক্ষীর ওই বক্তব্যের পরে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও সিপিএম তার আনুষ্ঠানিক কোনও নিন্দা করেনি। এ থেকে স্পষ্ট, দলগত ভাবে সিপিএম মনে করছে না মিনাক্ষী ‘ভুল’ করেছেন। রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম মিনাক্ষীর বক্তব্য প্রসঙ্গে আনন্দবাজার ডট কমকে বলেছেন, ‘‘তমন্নার মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর, ওই সমাবেশের মেজাজ দেখার পর এক জন বক্তাই ভাল বোঝেন, কী বলতে হবে।’’
অর্থাৎ, সেলিম ঠারেঠোরে মিনাক্ষীর পাশেই দাঁড়িয়েছেন। উল্লেখ্য, যে সভায় মিনাক্ষী অপশব্দ বলে বিতর্কে জড়িয়েছেন, সেই মঞ্চে বক্তৃতা করেছেন রাজ্য সম্পাদক সেলিমও। তিনি বলতে উঠে বলেছিলেন, ‘‘এখানকার এসপি বলছেন দুর্ঘটনাবশত বোমার স্প্লিন্টার লেগে তমন্নার মৃত্যু হয়েছে। এই এসপি-কে কিসের বাচ্চা বলব বলুন তো? আপনারাই বলুন কিসের বাচ্চা বলব?’’ জবাবে ঠাসা জমায়েত থেকে সমস্বরে সেই অপশব্দই উচ্চারিত হয়েছিল, যা মিনাক্ষীর মুখে তার আগে শোনা গিয়েছিল। অর্থাৎ, সেলিম জনতাকে দিয়ে যা বলিয়ে নিয়েছেন, মিনাক্ষী নিজমুখে সেটা বলে বসেছেন, যাকে ‘সূক্ষ্ম বৌদ্ধিক ফারাক’ হিসাবে দেখছেন অনেকে। আবার অনেকের মতে, সেলিমের ওই প্রয়াস খানিকটা মিনাক্ষীকে আড়াল করার জন্য। তাঁর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, ‘সমাবেশের মেজাজ’ বুঝেই মিনাক্ষী ওই অপশব্দ প্রয়োগ করেছিলেন।
মিনাক্ষীর কুকথার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে সিপিএমের কর্মী-সমর্থকদের অনেকে টানছেন প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথা। বুদ্ধদেব দলীয় কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে এক বার বলেছিলেন, ‘‘ওরা (তৃণমূল) যে ভাষা বোঝে, সেই ভাষাতেই ওদের (তৃণমূলকে) জবাব দিতে হবে।’’ তবে তার পাল্টা এমন প্রশ্নও উঠছে যে, বুদ্ধদেব কি কখনও প্রকাশ্য সভায় কুকথা বলতেন বা বলা সমর্থন করতেন? সিপিএমের মধ্যে যাঁরা মিনাক্ষীর কুকথা নিয়ে সরব, তেমন এক রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যের কথায়, ‘‘২০০৯ সালে হুগলির অনিল বসু যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সোনাগাছির যৌনকর্মীদের জুড়ে অশ্রাব্য বক্তৃতা করেছিলেন, তখন রাইটার্স থেকে বুদ্ধদা পার্টি অফিসে ফোন করে বলেোছিলেন, এখনই অনিলকে সেন্সর করার নোটিস জারি করতে হবে। তা-ই করেছিল দল। মিনাক্ষীর পক্ষে দাঁড়াতে বুদ্ধদার রাজনৈতিক কথাকে টেনে এনে আসলে তাঁকে অসম্মান করা হচ্ছে।’’
মিনাক্ষীর পক্ষে দাঁড়ানো কর্মী-সমর্থককুল বামফ্রন্টের প্রথম অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্রের একটি কথাও টেনে আনছে। অধুনাপ্রয়াত অশোক এক বার বলেছিলেন, ‘‘আমি ভদ্রলোক নই, আমি কমিউনিস্ট।’’ কিন্তু সিপিএমেরই প্রবীণ এক নেতার কথায়, ‘‘অশোকদার সেই কথা ভুল প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করা হচ্ছে। মনে রাখবেন, জ্যোতিবাবু কিন্তু লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসে রেল শ্রমিকদের আন্দোলন করে তাঁদের কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হয়েছিলেন। নিজেকে কমিউনিস্ট প্রমাণ করার জন্য তাঁকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে অপশব্দ ব্যবহার করতে হয়নি।’’ এর পাল্টা অনেকে বলছেন, জ্যোতিবাবু কলকাতার নেতা ছিলেন। আবার বর্ধমানের হরেকৃষ্ণ কোঙার ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে হামেশাই কুকথা বলতেন। যে ফারাকটা কলকাতার সেলিম এবং কুলটির মিনাক্ষীর মধ্যে দেখা গিয়েছে।
সিপিএমের অনেকে একান্ত আলোচনায় আবার পৃথক একটি আশঙ্কার কথা বলছেন। তাঁদের বক্তব্য, মিনাক্ষীকে অনুসরণ করতে গিয়ে পাড়ায় পাড়ায় পথসভায় স্থানীয় স্তরের তরুণ নেতারাও এর পরে অপশব্দ ব্যবহার শুরু করতে পারেন, যা হতে পারে সংক্রামক। স্থানীয় স্তরে তা রাজনৈতিক ভাবে হিতে বিপরীত হতে পারেও বলেও আশঙ্কা তাঁদের।
সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ তথা আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য যেমন প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেছেন, রাজনৈতিক কর্মীদের শব্দচয়নে সংযমী হওয়া প্রয়োজন। তবে দল নিন্দা না-করায় প্রথম সারির নেতাদের অনেকেই প্রকাশ্য মন্তব্য থেকে বিরত থাকছেন। যদিও একান্ত আলোচনায় মিনাক্ষীর কুকথা সম্পর্কে তাঁরা বলছেন, ‘‘এ-ও এক ধরনের ক্ষমতার ভাষা। যাতে সংসদীয় ছোঁয়া না-থাকলেও রয়েছে কমিটির সদস্য হওয়ার আস্ফালন।’’
তবে ভিতরে বিতর্ক থাকলেও মিনাক্ষীর কথা নিয়ে প্রকাশ্যে সিপিএম প্রশংসা বা নিন্দা কোনও দিকেই হাঁটতে চাইছে না। আলিমুদ্দিন মনে করছে, কয়েকটা দিন গেলেই এই বিতর্ক থিতিয়ে যাবে। কিন্তু সমাজমাধ্যমের এই রমরমার সময়ে অনেক কিছুই ফিরে ফিরে আসে। মিনাক্ষীর এই কুকথা সে ভাবে ‘অসময়ে’ ফিরে আসতে পারে বলেও আশঙ্কা দলের অনেকের। যেমন এখনও ফিরে আসে অনিল বসু বা হরেকৃষ্ণ কোঙারদের কুকথা।