• দেশের প্রবীণতম মেট্রোলাইন কি শুশ্রূষার অভাবে জরাগ্রস্ত? বৃষ্টির জল আবার ট্র্যাকে ঢুকে বিপর্যয়, প্রবীণ যাত্রীরা বিস্মিত
    আনন্দবাজার | ৩০ জুন ২০২৫
  • একটু ভারী বৃষ্টিতে রাস্তায় জল জমেছে কি জমেনি, মেট্রোর পাতালপথ ভেসে গিয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পরিষেবা। সোমবার সকাল থেকে বিপর্যয়ের যে ছবি কলকাতা মেট্রো রেলওয়ে দেখাল, তাতে বিস্মিত এবং শঙ্কিত অনেকেই। প্রবীণ যাত্রীদের অনেককেই বলতে শোনা গেল, ‘বৃষ্টিতে মেট্রো বন্ধ, ভাবতেই পারতাম না। এ বার কি এটাই আমাদের ভবিতব্য হতে চলেছে?’

    কলকাতার ‘ব্লু লাইন’ই দেশের প্রবীণতম মেট্রো লাইন। কিন্তু ইদানীং তার পরিষেবার মান নিয়ে যাত্রীমহলে নানাবিধ প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের বক্তব্য, কলকাতা মেট্রোর বয়স হয়ে গিয়েছে। লাইনে ঝাঁপ, প্রযুত্তিগত ত্রুটি তো লেগেই রয়েছে, মাঝে গোদের উপর বিষফোড়ার মতো কেউ আবার বিপদঘণ্টি (অ্যালার্ম) বাজিয়ে মেট্রোর ভিতরেই ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন। তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেই ব্যক্তির হদিস পাননি কর্তৃপক্ষ। এ সব নানা কারণে ইদানীং মাঝেমাঝেই মেট্রোয় দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে সাধারণ যাত্রীদের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিষেবা বন্ধ থেকেছে। তা নিয়ে ঠিক ভাবে ‘পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে’ ঘোষণাও করা হয় না বলে দীর্ঘ দিনের অভিযোগ যাত্রীদের। এর সঙ্গে গত বছর থেকে এক নতুন সমস্যা যোগ হয়েছে কলকাতা মেট্রোয় দুর্ভোগের তালিকায়— জলযন্ত্রণা!

    বর্ষাকালে শহরের রাস্তাঘাটে জল জমলে যাতায়াতের জন্য স্বাভাবিক ভাবে মেট্রোই বেছে নেন বহু মানুষ। সাধারণ যাত্রীরা ছাড়াও, যাঁরা সাধারণত বাসে-অটোয় যাতায়াত করে থাকেন, তাঁরাও ঘুরপথে হলেও ওই সময়ে মেট্রো ব্যবহার করেন। কিন্তু মাটির নীচ দিয়ে যাওয়া মেট্রোতেও যদি এখন জল জমে পরিষেবা ব্যাহত হয়, তা সত্যিই ‘দুর্ভাগ্যে’র বলে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন যাত্রীরা।

    সোমবার, সপ্তাহের প্রথম দিন, সকালের ব্যস্ত সময়ে দু’দফায় ব্যাহত হয়েছে মেট্রো পরিষেবা। সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত প্রায় দু’ঘণ্টা কবি সুভাষ থেকে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত সম্পূর্ণ পথে বন্ধ ছিল মেট্রো চলাচল। ভাঙা পথে চলে মেট্রো। প্রবল যাত্রীদুর্ভোগের মধ্যে মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানান, চাঁদনি চক এবং সেন্ট্রাল স্টেশনের মাঝে জল দেখা গিয়েছে। যাত্রীসুরক্ষার কথা মাথায় রেখেই পরিষেবা আংশিক ভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু কী কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়, এর প্রতিকার কী, তার কোনও সদুত্তর মেলেনি মেট্রো কর্তৃপক্ষের তরফে। তবে মেট্রোর এক কর্তা বলেন, ‘‘সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ বা মহাত্মা গান্ধী রোড এলাকায় রাত থেকে যে পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে, তা অস্বাভাবিক। রাস্তায় জল জমে গিয়েছে। অনেকেই আমাদের বলেছেন, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁদের মনে হয়েছে নদীর জল কেটে যাচ্ছেন যেন। এত বৃষ্টি হলে কারই বা কী করার থাকে!’’

    এখানে কি পুরসভার দিক থেকে কোনও গাফিলতি রয়েছে? পুরসভায় মেয়র পারিষদ (নিকাশি) তারক সিংহ বলেন, ‘‘আমাদের দিক থেকে কোনও গাফিলতি নেই। হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে জল জমার সমস্যা রয়েছে। তবে সেই জল দ্রুত নামানোর পরিকাঠামো রয়েছে আমাদের কাছে। কিন্তু এ বার ততটাও জল জমেনি।’’

    জল জমে মেট্রো পরিষেবা ব্যাহত হওয়ায় সোমবার বিপাকে পড়েছিলেন অফিসযাত্রী, স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা। তাঁদের অভিযোগ, ভাঙা পথে চলার সময়েও মেট্রো পরিষেবা বিঘ্নিত হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের পরে মেট্রো এসেছে। ফলে প্রবল ভিড় হয়েছে। ট্রেনের ভিতরেও একই অবস্থা। ভিড়ের চাপে দরজা বন্ধ হয়নি। যাত্রীদের অভিযোগ, এ সব কারণে ঠিকমতো এসি কাজ করেনি। ফলে দরদর করে ঘেমেছেন যাত্রীরা। সপ্তাহের প্রথম দিনেই সঠিক সময়ে অফিস, স্কুল, কলেজে পৌঁছোতে পারেননি তাঁরা। থিকথিকে ভিড়ে হাঁসফাঁস অবস্থা হওয়ায় অনেকে গন্তব্যের আগেই কোনও এক স্টেশনে নেমে গিয়েছেন। দমদমের বাসিন্দা বছর পঞ্চান্নের প্রসেনজিৎ দত্ত বলেন, ‘‘এত বছর ধরে মেট্রোয় যাতায়াত করছি, কোনও দিন দেখিনি, জল ঢুকে গিয়ে মেট্রো বন্ধ হয়ে গিয়েছে! গত বছর এক বার এ রকম ঘটেছিল বটে, তখন মনে হয়েছিল, এটা ব্যতিক্রম। এখন দেখছি এটাই নিত্যসঙ্গী। মেট্রোর যে বয়স হয়েছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে।’’

    সোমবার সকাল ১১টা নাগাদ মেট্রো পরিষেবা স্বাভাবিক হলেও নতুন করে বিপত্তি দেখা দিয়েছিল তার কিছু ক্ষণ পরেই। মেট্রো সূত্রে জানা গিয়েছে, বেলগাছিয়ায় ডাউন মেট্রো লাইনে এক ব্যক্তি ঝাঁপ দেন! তার জেরে আবার ব্যাহত হয় পরিষেবা। ভাঙা পথে মেট্রো চলে দক্ষিণেশ্বর ও দমদম এবং গিরিশ পার্ক থেকে কবি সুভাষের মধ্যে। পরে দুপুর ১২টা ২৮ মিনিট থেকে সম্পূর্ণ পথে ফের পরিষেবা শুরু হয়।

    মেট্রোয় জলযন্ত্রণার ছবি অবশ্য নতুন নয়। গত শনিবারই প্রায় সওয়া এক ঘণ্টা মেট্রো পরিষেবা ব্যাহত হয়েছিল উত্তর-দক্ষিণ মেট্রো (ব্লু লাইন)-র সুড়ঙ্গে ট্র্যাকের মাঝের নিকাশি নালায় জল উপচে পড়ায়। দমদমমুখী মেট্রো লাইনে যতীন দাস পার্ক এবং নেতাজি ভবন স্টেশনের মাঝে জলের পাইপ ফেটে ওই বিপত্তি ঘটে। এ রকমই ঘটনা ঘটেছিল গত বছরেও। ঘূর্ণিঝড় রেমালের জেরে রাতভর বৃষ্টি হয়েছিল শহরে। তার জেরে বিপর্যস্ত হয়েছিল ব্লু লাইনের মেট্রো। বৃষ্টির জল পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশনে ঢুকে পড়ায় প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ভাঙা পথে মেট্রো চলেছিল। শুধু স্টেশনে নয়, পার্ক স্ট্রিট এবং এসপ্ল্যানেডের মধ্যেকার ট্র্যাকেও জল থই থই করছিল। পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে মেট্রো স্টেশনের ভিতরে জল ঢুকে গিয়েছিল। দেওয়ালের ফাটল দিয়েও জল চুঁইয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছিল সেই দিন। শেষমেশ পাম্প এনে লাইন এবং স্টেশন থেকে জল বার করে মেট্রো।

    পরে কর্তৃপক্ষ জানান, মেট্রোর সুড়ঙ্গের ঠিক উপরেই কলকাতা পুরসভার নিকাশি নালা রয়েছে। ইটের তৈরি শতাব্দীপ্রাচীন নর্দমায় প্রচুর পরিমাণে পলি জমে যাওয়ায় উপচে পড়েছিল বৃষ্টির জল। সেই জলই নর্দমার গর্ত দিয়ে মেট্রো স্টেশনে ঢুকে পড়েছিল বলে জানিয়েছিলেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর পুরসভাও নর্দমা মেরামতের আশ্বাস দিয়েছিল। তবে তাদেরও বক্তব্য, মেট্রোর ‘ডি-ওয়ালে’ ফাটল ছিল। সেখান থেকেই জল ঢুকেছে।

    পার্কস্ট্রিট মেট্রো স্টেশনের ফাটল মেরামত করা হলেও, বাকি স্টেশনগুলিতে কেন রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হল না, সোমবারের ঘটনার পর এই প্রশ্নই তুলছেন অনেকে। চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে ছিলেন তমালিকা সেন। তিনি বলেন, ‘‘মেট্রোয় জল ঢোকে কী ভাবে? এর আগে পার্কস্টিটেও একই ঘটনা ঘটেছিল। কেন ঠিক ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হয় না? মেট্রো কর্তৃপক্ষ এতটা কী করে উদাসীন হতে পারেন!’’

    মেট্রো কর্তৃপক্ষের অবশ্য বক্তব্য, চাঁদনি চক এবং সেন্ট্রালের মাঝে ট্র্যাকে যে জল জমতে পারে, তা আগে জানা ছিল না। সোমবারই বিষয়টি নজরে এল। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘যে মুহূর্তে বিষয়টি নজরে এসেছে, সেই মুহূর্তেই পদক্ষেপ করা হয়েছে। যাত্রীসুরক্ষার কথা মাথায় রেখেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর মেট্রো কিন্তু কখনওই পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। একটি অংশে বন্ধ রাখা হয়েছিল। সেই সময়ে মেট্রো আধিকারিকেরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পাম্প এনে জল বার করে দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছেন।’’

    কলকাতার গণপরিবহণ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মেট্রো। এতকাল উত্তর শহরতলি থেকে দক্ষিণ শহরতলিতে মেট্রো চলাচল করত। সম্প্রতি পূর্ব-পশ্চিমেও জুড়েছে এই পরিষেবা। কিন্তু এখনও শহরের মূল জীবনরেখা (লাইফলাইন) উত্তর-দক্ষিণ মেট্রোই। প্রতি দিন এই পথে প্রায় ৬ লাখ মানুষ যাতায়াত করেন। সেখানে কোনও না কোনও বিভ্রাট লেগেই রয়েছে নিত্য দিন। গত সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর রাখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়।

    গত ২৫ জুন, বুধবার সকাল সওয়া ৯টায় রবীন্দ্র সরোবর স্টেশনে দক্ষিণেশ্বরগামী মেট্রোয় আচমকাই বেজে উঠেছিল ‘প্যাসেঞ্জার অ্যালার্ট ডিভাইস’! মেট্রোর রেকে কোনও বিপদ ঘটলে যাত্রীরা এই যন্ত্রের বোতাম টিপে চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন। সেই বোতামই কেউ টিপে দিয়েছিলেন। প্রথমে যাত্রীরা বুঝতেই পারেননি কেন মেট্রো দাঁড়িয়ে গেল। অনেকেই ভেবেছিলেন, নিশ্চয়ই কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি হয়েছে! কিছু ক্ষণ পরে চালক ছুটে যান ওই কামরায়। জিজ্ঞাসাও করেন, কে ওই অ্যালার্ম বাজালেন, কেন বাজালেন। যদিও কোনও যাত্রীই উত্তর দিতে এগিয়ে আসেননি। এই ঘটনার জেরে বেশ কিছু ক্ষণ পরিষেবা বিঘ্নিত হয় ব্যস্ত সময়ে।

    সপ্তাহান্তেও প্রযুক্তিগত গোলযোগের কারণে ময়দান থেকে কবি সুভাষ পর্যন্ত মেট্রো চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ময়দান থেকে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত ভাঙা পথে মেট্রো চলছিল। শেষমেশ ঘণ্টাখানেক পর স্বাভাবিক হয় পরিষেবা। সোমবার মেট্রো স্টেশনে জল ঢুকে পড়া এবং জনৈকের আত্মহত্যার চেষ্টায় দীর্ঘ ক্ষণ পরিষেবা ব্যাহত হওয়ায় সব ঘটনা নিয়েই ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন যাত্রীরা। শোভন মল্লিক নামে এক যাত্রী বলেন, ‘‘দু’দিন ছাড়া ছাড়া এটা চলছে মেট্রোয়। রাস্তায় জ্যাম। মেট্রোয় জল। মানুষ যাবে কোথায়? এটা কী হচ্ছে? আর এরা ঠিকমতো ঘোষণাও করে না। জানায়ও না কী হয়েছে, কত ক্ষণ বন্ধ থাকবে? এগুলো না-জানালে তো বুঝতেও পারি না কী করব, অন্য কোনও ভাবে অফিস যাওয়ার ব্যবস্থা করব কি না। মহা মুশকিলে পড়া গেল!’’

    ঠিক ভাবে, সময়মতো ঘোষণা না-হওয়ার অভিযোগ অবশ্য মানতে চাননি মেট্রো কর্তৃপক্ষ। এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এটা একেবারে ভুল কথা। আজকের কথাই যদি ধরি, সব ক’টি ঘটনার কথা ঠিক ঠিক সময়ে মাইকে জানানো হয়েছে। মেট্রোর একটি অ্যাপও রয়েছে। সেখানে সময়ে সময়ে আপডেট দেওয়া হয়। মেট্রো কর্তৃপক্ষ যখন যা সিদ্ধান্ত নেন, তা ওখানে জানানো হয়। আর মেট্রোর অ্যালার্ম বাজিয়ে দেওয়া বা প্রযুক্তিগত ত্রুটি তো কারও হাতে থাকে না। যখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটে, মেট্রো কর্তৃপক্ষ তৎপর হয়ে কাজে নামেন এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। মেট্রো কর্তৃপক্ষ যাত্রী পরিষেবার ব্যাপারে কখনওই উদাসীন ছিলেন না। থাকবেনও না।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)